‘অ্যা উইম্যানস প্লেস ইন দ্যা সিটি’ । ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে টরন্টোর ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিষয়ের অধ্যাপক গারদা ওয়েকারলে লিখেছিলেন,নারীর অস্তিত্বকে সমর্থন করতে শহরের ক্ষমতা মৌলিক ও একক। নারীর ঘরোয়া জীবন ও নাগরিক জীবন এবং অর্থনৈতিক জীবনে শহরের প্রভাব গুরুত্ব বহন করে।
সাংস্কৃতিক এবং যৌক্তিকভাবে ভাবে ভাবলে একটি শহর স্বাধীনতা এবং সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। এরপর অন্তত ৩০ বছর কেটে গেছে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয় লেসলি কার্নের বই ‘ফেমিনিস্ট সিটি, ক্লেমিং স্পেস ইন এ ম্যান-মেইড ওয়ার্ল্ড’। গারদা ওয়ারকারলে তাকে এ বিষয়ে গবেষণা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এরপর ২০২২ সালে অক্টোবরের ২৭ তারিখে প্রথমবারের মত যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো সিটি কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে ‘নারীর শহর পরিকল্পনা’ কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা উচিত— এমন প্রস্তাব সমর্থন করে গ্লাসগো সিটিকে যুক্তরাজ্যের প্রথম নারীর শহর বা ‘নারীবাদী নগরবাদ’ পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
সাধারণ নগর পরিকল্পনা সাজানো হয় পুরুষতান্ত্রিক নিয়মে অন্যদিকে নারীবাদী নগর এমন এক ধরনের নগর পরিকল্পনা যাতে সবাইকেই অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়। নারী, নন-বাইনারী মানুষ এবং জেন্ডারফ্লুইড মানুষকে নিয়েও উদারনৈতিকভাবে ভাবা হয়। খুব আশ্চর্যের হলেও পৃথিবীর শহরগুলো লিঙ্গ-নিরপেক্ষতার ভাবনা থেকে অনেক দূরে।
নারীবাদী নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলেন, ঐতিহাসিকভাবে নগর ডিজাইনের দায়িত্বে রয়েছে পুরুষ এবং তারা তাদের নিজস্ব চাহিদা ও অভ্যাসের কথা চিন্তা করেই নগর সাজিয়ে। নারী, তৃতীয় লিঙ্গ ও ননবাইনারী মানুষের সুবিধা ও প্রয়োজনের কথা ভাবেনি। পুরুষতান্ত্রিক এ নগর ডিজাইনে যৌন ও লিঙ্গ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং সুবিধা গ্রহণ করতে না পারার সমস্যাকে একেবারেই উপেক্ষা করা হয়।
আমরা যে শহরগুলোতে থাকি সেগুলোর জীবনযাত্রাকে আমরা অনুভব করতে পারি। লিঙ্গ পরিচয়, জাতিসত্তা এবং বয়স আমাদের নগর জীবনে খুব গুরুত্ব বহন করে। একজন একজন সমকামী কালো কিশোর, অথবা একজন বয়োবৃদ্ধ অথবা একজন প্রতিবন্ধী বা নারী সবাই নগর জীবনে কিছু অন্যরকম অভিজ্ঞতা পান। আমাদের শহরগুলো প্রত্যেকের চাহিদার কথা চিন্তা করে তৈরি করা হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে, পুংলিঙ্গ-পক্ষপাতযুক্ত নগরী মানুষের জন্য স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
গ্লাসগো কাউন্সিল নোট করেছে, যে শহর উন্নয়নের জন্য একটি লিঙ্গ-নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে না, যে শহর নারী এবং প্রান্তিক মানুষ ও অন্য লিঙ্গের মানুষের চাহিদায় গুরুত্ব দেয় না এমন শহরকে পরিবর্তনে তারা যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছেন। নগরে সবার অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জলবায়ু-বান্ধব পদ্ধতির প্রয়োজন।
গ্লাসগো গ্রিন কাউন্সিলর হলি ব্রুস বলেছেন, তিনি স্কটিশ শহরে যুগান্তকারী এ গতিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। গ্লাসগো কাউন্সিল সম্মত হয় পাবলিক স্পেসগুলি তৈরির সময় নারীর জন্য নিরাপদ এবং সহজসাধ্য, এবং জাতিবর্ণ সব সম্প্রদায়ের সকল সদস্যের জন্য অ্যাক্সেসযোগ্য হবে।
ব্রুস বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমি এখনও জানি না কারণ এই পদ্ধতির পুরো বিষয়টি এগুবে নারীর সাথে পরামর্শ করে এবং তাদের প্রশ্ন করে যে তারা কি চায়”। গ্লাসগো কাউন্সিল কোন পরিবর্তনেকে এগিয়ে নেওয়ার আগে সাধারণ মানুষের সাথে পরামর্শ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নাগরিকদের জিজ্ঞেস করা হবে যে তারা তাদের শহরে কী কী ব্যবস্থা বাস্তবায়িত দেখতে চায়।
‘আমি বলতে পারি যে আমি সত্যিই প্রশস্ত ফুটপাথ এবং রাস্তায় আরও আলো চাই, কিন্তু আমি একজন সুবিধাভোগী শ্রেণির শাদা ও সক্ষম দেহের নারী, তাই আমি জানি না প্রত্যেকের কী প্রয়োজন—ব্রুস বলেছিলেন।
অনেক নারী জানিয়েছেন, তারা পার্কের নির্দিষ্ট অংশে আরও আলো চান যাতে তারা রাতে সেখানে ঘুরতে পারেন এবং তারা সেখানে সময় কাটাতে পারেন। কারণ মুক্ত ও মনোরম জায়গায় নিরাপদে ভ্রমণের অধিকার আছে নারীরও। লন্ডনে সারাহ এভারার্ডকে অপহরণ ও হত্যার পর ২০২১ সালে ইয়াং উইমেন লিডের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে গ্লাসগোতে বেশিরভাগ নারী এবং নন-বাইনারি মানুষ বাস ও বাস স্টপে অনিরাপদ বা অস্বস্তি বোধ করেন। ব্রুস বলেন, করোনা মহামারী দেখিয়েছে যথেষ্ট পাবলিক টয়লেটের অভাব নারীদের অসুবিধেয় ফেলেছে।
কাউন্সিলর ব্রুস বলেছেন যে তিনি শহরগুলির নেতৃত্ব অনুসরণ করবেন যা ইতিমধ্যেই নারীবাদী শহর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাছাকাছি। যেমন ভিয়েনা বিস্তৃত ফুটপাথ চালু করেছে যা প্র্যামসহ অভিভাবক, পাশাপাশি হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ও অন্যান্য পথচারীদের না আটকে বরং শহরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে দেয়। এছাড়াও নারীবান্ধব আইন আইন পাস করার পর ইউরোপ নারীবাদের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠছে, যা নারীর পিরিয়ড পণ্যকে সবার জন্য একেবারেই বিনামূল্যে করে দিয়েছে।