‘আমার বউ কোন কাজ করে না সে হাউজওয়াইফ’
মিনুর সকাল থেকে রাত অবধি কাজের অন্ত নেই। বাচ্চাদের স্কুল, স্বামীর অফিস টিফিন তৈরি, রান্নাবান্না, ঘরের অন্য কাজ করাই তার জগৎ। উচ্চ শিক্ষিতা মিনুর স্বামী সজীব চায়নি সে চাকরি করুক। আর সেও তা মেনে নিয়েছে। তবে বন্ধুরা বলেছিল কিছু করতে। কিন্তু স্বামী, সংসার সন্তানদের কথা চিন্তা করে ঘরের বাইরে কাজ করা হয়নি তার।
মিনুর স্বামী সজীব যখন বলে ‘আমার বউ কোন কাজ করে না’ তখন মিনু মনে মনে কষ্ট পায়। তার সংসারের জন্য কাজ করার কোন মূল্য নেই৷ চাকরি করে উপার্জন করতে পারাটাই কেবল কাজ । ভুল করছে সে সংসার নিয়ে পড়ে থেকে?
মিনুর মত হাজারো নারীদের শুনতে হয় এ কথা। যা একটা ভ্রান্ত ধারণা। ঘর সংসার সামলানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করাটাকে সজীব ‘কাজ’ বলে মানতে নারাজ। কথায় কথায় বলে ‘সারাদিন ঘরেই থাকো, বাইরের কাজ কি বুঝবে? ‘ দেশের অধিকাংশ গৃহিণী নারীদের খুব সহজে এসব কথা বলে দেয় সজীবের মত স্বামীরা ৷ তারা কোন সময় চিন্তা করে দেখে না ঘর সংসারের কাজগুলোকে আর্থিকভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। এর মূল্যায়ন করতে হবে দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে। আর এ দৃষ্টিভঙ্গীর অভাবে সংসারে স্ত্রী হয় অবহেলার শিকার। কিন্তু স্বামী সন্তানের সফলতার অন্তরালে ঘরের নারী অবদানকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এর গুরুত্ব কতটা। দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে যে ছেলেটি সহায়ক ভুমিকা রাখে, তাকে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে ঘরের গৃহিণী মাই জন্ম দিয়ে লালন পালন করেছে । আর মায়ের এ দায়িত্বকে অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
‘হাউস ওয়াইফ’ বলে যে স্ত্রীকে তাচ্ছিল্য করা হয়, সে স্ত্রীই স্বামীকে ছায়া সংগী হয়ে কর্মক্ষেত্রে সফল করে। দেখা যায় সংসারের কোন দায়িত্ব স্বামীর ঘাড়ে না দিয়ে হাউস ওয়াইফ স্ত্রীই সামলাচ্ছে সব। আর তার সব কাজই সেবামূলক কাজ হিসাবে গণ্য হয়। যেমন একজন গৃহিনী রান্না করে পরিবারের সদস্যদের জন্য। এটাকে হোটেলের শেফের বেতন দিয়ে বিচার করা যায় না। আবার সন্তানকে নিজে স্কুলে আনা নেওয়া করে তার নিরাপত্তা ও ঘরের খরচ কমাতে। এ কাজটিকে অফিসের কাজের সাথে তুলনা করা সম্ভব নয়। স্বভাবতই পারিবারিক জীবনে স্বামী বাহির সামাল দেন, স্ত্রী ঘর।
বাইরের কাজ থেকে অর্থ আসে বলে সেটার মূল্যায়ন হবে আর ঘরের কাজে নগদ অর্থ দৃশ্যত নয় বলে অবমূল্যায়ন করাটা বৈষম্যতা সৃষ্টি করে সন্দেহাতীতভাবে। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের ‘প্যাটার্ন অফ টাইম ইউজ অফ অ্যাডাল্ট ম্যান অ্যান্ড ওম্যান’ নামের এক গবেষণায় দেখা যায় , ‘একজন নারী প্রতিদিন গড়ে আট ঘণ্টা ঘরের সেবামূলক কাজে ব্যয় করেন৷ সেখানে পুরুষ করে মাত্র এক ঘণ্টা ২০ মিনিট৷ অথচ নারীর এই সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই৷
এমনকী নারীদেরও বড় একটা অংশ মনে করেন যে, এটা তাদের জীবনে স্বাভাবিক কাজ৷ এর আবার মূল্যায়ন কি? বস্তুত তারা তাদের সময় এবং পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজের মূল্যায়ন নিয়ে সচেতন না৷ এ গবেষণায় আরও দেখা যায় পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন না থাকায় নারী অবহেলিত হয় ৷ অন্যদিকে আমাদের মোট জাতীয় আয়েও এর কোনো প্রতিফলন নেই৷”
এ নারীদের কাজের মূল্যায়ন করে জিডিপিতে সংযোগ করার জন্য অর্থনীতিবিদরাও এখন পর্যন্ত কোন পদ্ধতি বের করতে পারেন নাই। এর ফলে সারা বিশ্বে নারীদের কাজের একটা বড় অংশের মূল্যায়ন ও মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না। উল্টো ধারণা করা হয় স্ত্রীর হাত খরচ বা অন্য বিষয়াদি বাড়তি ঝামেলা। এ অবমূল্যায়নের প্রত্যক্ষ ফলাফল হলো, ‘মর্যাদাহীনতা নারীর জীবন।’
পরিবারে মজুরিবিহীন কাজে সারাদিন ব্যয় করার পরেও অর্থনৈতিক মূল্য না থাকার কারণে নারীর ভুমিকাকে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু লিঙ্গ বৈষম্য ও নারীর মত অবহেলিত মনোভাব কাটাতে এ দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন দরকার।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও সিপিডির এক গবেষণা থেকে জানা যায়, মজুরিবিহীন নারীরা নানাভাবে শ্রম ও সময় দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষভাবে ভুমিকা রাখছে। যা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি ।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের একজন নারী সমবয়সী একজন পুরুষের তুলনায় প্রায় তিনগুণ সময় এমন কাজ করে, যা জাতীয় আয়ের হিসাবে যোগ হয় না। আবার একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২.১ টি কাজ করে, যা মজুরিবিহীন। তবে এটি জাতীয় আয়ের হিসাবে ( জিডিপি) যোগ হয়না। পুরুষের ক্ষেত্রে এধরণের কাজের সংখ্যা মাত্র ২.৭টি ।
‘আমার স্ত্রী কাজ করে না’— কথাটা বলার আগে ভাবতে হবে অফিসের নটা পাঁচটার টার কাজের তুলনায় সংসারের ২৪ ঘণ্টার কাজ কোন অংশে কম নয়। আর আধুনিক সময়ে হাউস ওয়াইফদের বলা হয় হোম মেকার।। সত্যিকারভাবে একজন গৃহিণীই পারে সংসারটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে। তার দেখভাল আর ঘরকন্নার কাজেই ঘর ঘর হয়। দিন শেষে ঘরে ফিরে আরাম আয়াশের পরিবেশ দেয় যে স্ত্রী, তার কাজকে মূল্যায়ন দেয়া মানসিকতা তৈরি করতে হবে সজীবের মত স্বামীদের। তবেই মিনুর মত স্ত্রীরা বলতে পারবে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমরাও সামিল।
লেখক – কলামিস্ট