নাম সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি হলেও গল্পটি ছয় গজের শাড়ির নয়। গল্পটি একটি গয়নার উদ্যোগের, একজন আর্কিটেক্টের গয়নার ডিজাইনার হওয়ার। গল্পটা অসামান্য পূর্ণতা পায় যখন সাধারণ একটি ফেসবুকের উদ্যোগ দেশের গয়নাকে আন্তর্জাতিক বাজারে নিয়ে যায়, যখন সব গল্পের সেরা গল্প হয়ে সোনা–রুপাকে ছাপিয়ে ধাতুর তৈরি গয়না অর্জন করে অনেক কিছু।
তিনি জেরিন তাসনিম খান লোরা। সবাই অবশ্য লোরা খান নামেই জানে। লেখাপড়া করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচারে। ইট-কাঠ-কংক্রিটের নকশার চেয়ে গয়নার নকশাতে তিনি পেয়েছেন কাজের সার্থকতা। যদিও লোরার এত বড় একটা সাধ ছিলই না, তিনি শুধু ‘কিছু একটা’ করতে চেয়েছিলেন, যেন ‘কেউ একজন’ হয়ে ওঠা যায়। এই বোধ থেকে একদিন লোরা মায়ের থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার এনে শুরু করেন সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি নামের একটা ফেসবুক পেজ।
লোরা বলেন, ‘শুরুতে উদ্যোগটা শাড়িরই ছিল, পাশাপাশি কিছু গয়নাও ডিজাইন করলাম। পুরান ঢাকা ঘুরে কয়েকজন গয়নার কারিগরকে রাজি করালাম আমার ডিজাইনমতো কাজ করতে। এরপর সেগুলো পেজে তুলতেই বিক্রি হয়ে গেল নিমেষেই। এভাবে বাজার আমাকে জানিয়ে দিল আমার পথ কোথায়!’
সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি জনপ্রিয় তার অনন্য ডিজাইনের জন্য। সাধারণ ফুল–লতাপাতা থেকে বের হয়ে এসে সিক্স ইয়ার্ডস বানিয়েছে এমন সব গয়না, যা ধারণ করে বাংলাদেশকে। তাই সহসাই কানে ঝোলে বাংলাদেশের একটা মানচিত্র অথবা বর্ণ। শুধু তা–ই নয়, হালের ভারতীয় ডিজাইনের গয়নার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া দাদি–নানিদের সাবেকি ডিজাইনের গয়নাও সিক্স ইয়ার্ডসের মুনশিয়ানায় চলে আসে আধুনিক কোনো নারীর গয়নার বাক্সে। তবে সিক্স ইয়ার্ডসের সব সাফল্যের বড় সাফল্য তারা বানায় কাস্টমাইজড গয়না। একদম বিয়ের কনের মনমতো। এভাবে কনের গয়নায় উঠে আসে মূল্যবান রত্ন, পাথর, মুক্তার পাশাপাশি সাধারণ কড়ি বা শোলাও।
লোরা বলেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার ক্রেতারা। তাঁদের অধিকাংশই কর্মজীবী শিক্ষিত নারী। নিজের সাজপোশাকের আর্থিক স্বাধীনতায় তাঁরা অনায়াসেই ধারণ করতে পারেন যেকোনো উপকরণের গয়না। আবার প্রতিদিন নতুন নতুন ডিজাইনের অনেক গয়না লেগেই যায়। ক্রেতারা তখন ধাতুতে খরচ না করে ডিজাইনে করেন, এভাবেই সোনা–রুপাকে পেছনে ফেলে সিক্স ইয়ার্ডসের ধাতব অলংকার হয়ে ওঠে অনন্য।’
‘ক্রেতাদের ধাতুর বাছবিচার না থাকলেও কারিগরদের জন্য ধাতু খুব জরুরি’, বলেন লোরা। ‘দেখা যায় যে অনেক সময় কারিগরেরা সোনা বা রুপা ছাড়া নির্দিষ্ট ডিজাইন তুলতে পারেন না। আবার অনেক সময় তাঁদের অহং–এ লাগে, কেন কমদামি ধাতুতে কাজ করব?’ এই বিশাল সমস্যা পার করে একেকটি ডিজাইন নামাতে গলদঘর্ম হতে হয় তাঁকে।
এসব পেরিয়ে যখন একটা ডিজাইন নামিয়েও নেওয়া যায়, তখন শুরু হয় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নিজের নকশাকে রক্ষা করার। একজন স্বাধীন কারিগর সহজেই অন্য কোনো গয়নার উদ্যোগকে দিয়ে দেন তাঁদের ডিজাইনটা, এসব বিষয়ে কপিরাইট আইনের চর্চাটাই নেই দেশে।
এমন সব সীমাবদ্ধতা নিয়েই সিক্স ইয়ার্ডস পার করেছে ছয় বছর। ছয় বছরে সাধারণ একটি ফেসবুক পেজ থেকে সিক্স ইয়ার্ড এখন অনেক কিছু। নাহয় এখন আর শাড়ি বিক্রি করে না, তবে গয়নাও আটকে নেই শুধু কানের দুল নাকের ফুলে, সিক্স ইয়ার্ডস কোমরের বিছা, মাথার মুকুট এমনকি চশমার বাহারি চেন—সবই যুক্ত হয়েছে গয়নার এই জাদুর বাক্সে। এসব নিয়েই লোরা এখন পৌঁছে গেছেন কেনাবেচার আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট আমাজনে। আগামী মাস থেকেই তাঁদের গয়না পাওয়া যাবে আমাজনের ওয়েবসাইটেও।
‘তারপরেও কাছের মানুষরবিশ্বাস করেন না গয়নাটা আমার ডিজাইন করা। কারণ, এখন পর্যন্ত কোথাও আমার নাম আসেনি।’ হেসেই বলেন তিনি।
সিক্স ইয়ার্ডসের এখন একটা অফিস আছে। জেরিন তাসনিম খান লোরা মনে করেন, এই অফিস নেওয়াটাই তাঁর জীবনের একটা ‘টার্নিং পয়েন্ট’। ‘আমার তখন অফিস নেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, কিন্তু আমি সাহস করে আরেকটা উদ্যোগের সঙ্গে একটা জায়গা নিয়ে নিই। এখন আমার ১৮ জন কর্মী, সম্প্রতি কারখানাও দিয়েছি।’
নারী হিসেবে উদ্যোক্তা জীবনে সুবিধাই পেয়েছেন, এমনটাই মনে করেন তিনি। তবে সীমাবদ্ধতাও কম ছিল না। ঘর থেকে কাজ শুরু করা, এই পেশাতেই থিতু হবেন পরিবার থেকে সেই অনুমোদন পাওয়া, সব নিয়ে ঝামেলা কম হয়নি। এর মধ্যেই বিয়ে হয়েছে, হয়েছে সন্তানও। ভারসাম্য রাখতে হয়েছে সবগুলোতেই। প্রতিটা পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে সামলেছেন যেন বাইরে থেকে বোঝা না যায় ব্যবসার মূল মানুষটাই কর্মক্ষম নেই। লোরা বলেন, ‘ছয় মাসের জন্য নতুন কালেকশন গুছিয়ে, মডেল ফটোশুট করে ছুটি নিয়েছি, ছয় মাসের প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত না থেকে সরব রেখেছি ব্যবসাটা’।
এক পা এক পা করে এগোচ্ছে সিক্স ইয়ার্ডসের ‘স্টোরি’, অন্য সব ক্ষুদ্র উদ্যোগের মতো। তবে লোরার স্বপ্ন বড়, তিনি চান গয়নার একটি বিশ্বমানের ব্র্যান্ড তৈরি করতে, এখন শুধু সেই লক্ষ্যের জন্য লড়ে যাওয়া।