এক রাতে এক ছাদের তলায় জড়ো হল চার নারী। নিজের জীবনের অপমান-গ্লানি নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিলো ডিটেকটিভ দল গঠন করার। দলে যোগ দেয় আরও নারী। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয় ধনী গৃহিণীদের স্বামীর গোপন তথ্য স্ত্রীদের দেওয়ার কাজ করে দেবে চুরাইলস বাহিনী বিনিময়ে নারীরা চুরাইলসদের টাকা দেবে। ‘আগার আপকো লাগতাহে আপকা শহর বেওয়াফা তো আপ হামে কল কারে’ ‘মার্দ কো দার্দ হোগা’—এসব বাক্যের গোপন বিজ্ঞাপন ছেয়ে যায় করাচি শহরতলির নারীদের হাতে হাতে। গোপন ক্যামেরা, হ্যাকিং সামগ্রীসহ চুরাইলস দল জানতো না শুধু স্বামীর পরকীয়া নয় নারীর জন্য থাকে আরও হাজার রকমের নির্যাতন। ধীরে ধীরে চুরাইলস দল জড়িয়ে পড়ে ঘরোয়া সহিংসতায় আক্রান্ত নারীর জন্য, বিউটি ক্রিম কোম্পানির বিরুদ্ধে সবশেষে ইচ্ছের বিরুদ্ধে পতিতাবৃত্তির র্যাকেট থেকে বাঁচিয়ে আনে নারীদের।
পাকিস্তানি চলচ্চিত্র নির্মাতা ওয়াসিম আব্বাসি ১০ পর্বের এই ওয়েব সিরিজে নারী নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অশ্লীলতা ও দ্বৈত নীতির বর্ণনা হয়েছে নারীবাদী তত্ত্বে। প্রধান চার নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন সারা খান চরিত্রে সারওয়াত গিলানি, জোবাইদা চরিত্রে মেহের বানো, বাটুল জান চরিত্রে নিমরা বুচা, জুগনু চৌধুরী চরিত্রে ইয়াসরা রিজভি।
চুরাইলস নামকরণ কেন?
ইংরেজিতে উইচ, বাংলায় ডাইনি ও উর্দুতে চুরাইলস। নারী সম্পর্কে নারকীয় বর্ণনা। পুরষতন্ত্র তাদের নিয়মের অবাধ্য নারীকে ডাইনি বা উইচ বলার ইতিহাস অনেক পুরনো। কতো নির্দয় ও নৃশংস পন্থায় নারীদের খুন করা হত ডাইনি ঘোষণা দিয়ে। নঞবাচক নারী মানে ডাইনি। মধ্যযুগ থেকে এখনও নারীর নেতিবাচক বর্ণনায় আসে ডাইনি শব্দটি। ওয়াসিম আব্বাসি এখানে দেখিয়েছেন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মেয়েরা নিজেদের চুরাইলস বলে। নারীদের ওই ডিটেকটিভ সংগঠনটির নামও চুরাইলস। সে দৃষ্টিকোণ থেকে চুরাইলস নামকরণটি যথার্থ।
ওয়েব সিরিজটিতে দেখতে পাই চারজন নারী এক হয়ে নির্যাতক পুরুষদের শায়েস্তা করতে দল বানায়। ওই দলের নাম হয় চুরাইলস। ১০ পর্বের এ চুরাইলস ওয়েব সিরিজটি গল্প বলেছে নারীর ঐক্য, সিস্টারহুড, নারী ও নারীর প্রেম, বর্ণবাদ, নির্যাতক পুরুষের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিরোধের।
এখানে দেখা যায় চার নারী যারা ভিন্নভাবে পুরুষের নির্যাতনের শিকার তারা একত্রিত হয়। গড়ে তোলে চুরাইলস নামের একটি গোপন সংগঠন। ওই সংগঠনের নারীরা মূলত স্বামীদের ব্যক্তিগত জীবনে গোয়েন্দাগিরি করে স্ত্রীদের তথ্য দেয়। চার চুরাইলস একটা বাহিনী বানিয়ে ফেলে এবং এক্টার পর একটা ঘটনার জন্ম দেয়।
জুগনু
ধনীর ঘরে জন্ম নেওয়া জুগনু (ইয়াসরা রিজভি) একজন হাই-প্রোফাইল ইভেন্ট ম্যানেজার। তিনি ধনী, ডিভোর্সী ও মানুষের সাথে কম মেশেন। নিগ্রো পুরুষকে বিয়ে করে নিজের পরিবারে প্রত্যাখ্যাত হন। বিয়ের পর তার গর্ভে আসা ভ্রুণ শিশুকে নষ্ট করে মানসিক যাতনায় থাকেন ও অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে থাকেন।
সারা
পারফেক্ট সুন্দরী পারফেক্ট ওয়াইফ পারফেক্ট হোমমেকার সারা। সারা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সারওয়াত গিলানি। আইনজীবী সারা গৃহিণী হয়ে জীবন কাটায় স্বামীকে সুখে রাখতে। একরাতে সারার সামনে উন্মোচিত হয় তার ধনী স্বামীর ব্যভিচার ও নারী কেলেংকারি। সে রাতেই সারা চলে যায় বন্ধু জুগনুর বাড়িতে।
বাটুল
তৃতীয় চরিত্র বাটুল (নিমরা বুচা)। বাটুল একজন জেল ফেরত মধ্যবয়সী নারী, নির্যাতক স্বামীকে খুন করে বিশ বছর জেলে কাটিয়ে বাইরে এসেছেন। তার জীবনের একটা উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলা কন্যাকে খুঁজে পাওয়া। জেল থেকে ফিরে সে ঝিয়ের কাজ নেয় জুগনুর বাড়িতে।
জুবাইদা
চতুর্থ চরিত্র কলেজ পড়ুয়া জুবাইদা। উইকির মতে জুবাইদা অর্থ নরম ও কোমল। জুবাইদা চরিত্রটি করেছেন পাকিস্তানি অভিনেত্রী মেহের বানো। জুবাইদা নামের কোমলতার আদতে ভীষণ শক্ত। জুবাইদা বক্সিং প্রাক্টিস করেন আর নিজের রক্ষণশীল পরিবারে পিতার অত্যাচারের শিকার। জুবাইদা মুক্ত হতে চাইত বক্সার হবে বলে। জুবাইদা বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে ফ্লার্ট করে সেটি পরিবার জানলে তাকে ভয়াবহ নির্যাতন করে। সে রাতে বাটুল জুবাইদাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় জুগনুর বাড়িতে।
স্বামীর কাছে নিখুঁত স্ত্রী হতে সারা আইনজীবী হয়েও আইনচর্চা করেনি। সাজে পোশাকে সবসময় পরিপাটি ও সুন্দরী গৃহিণী হয়ে থাকা সারাকে স্বামী যখন ‘রাস্টি’ বলে গোপনে কেঁদে আবারও পটের বিবি হয়ে স্বামীর সেবা করে। সারার সমস্ত বিশ্বটা ভেঙ্গে পড়ে যখন সে স্বামীর পরকীয়া, ডার্টি মেসেজ ও চরম অবিশ্বস্ততা দেখে। পুরুষতন্ত্রের নির্লজ্জ বিধান সারার কাছে তখন আরও পরিস্কার হয়ে যায়।
সেই রাতে সারাসহ ইভেন্ট ম্যনেজার জুগনুর ঘরে এক হল চার নারী। অল্পবয়সী বক্সার জুবাইদা, জেল ফেরত নিষ্ঠুর বাটুল, স্বামীর প্রতারণার শিকার বুদ্ধিদীপ্ত আইনজীবী সারা।
চুরাইলস দল বানানোর বাণিজ্যিক ধারণা আসে সারার কাছ থেকেই। উপস্থিত বাকি তিনজনও রাজি হয়ে যান। চুরাইলস গ্যাং হল মার্দ কো দার্দ হোগা বিজ্ঞাপণ বার্তা নিয়ে। চুরাইল গ্যাং এর কাজ হবে ধনী নারীদের স্বামীর ব্যক্তিগত জীবন অনুসন্ধান করে স্ত্রীদের কাছে প্রমাণসহ তথ্য সরবরাহ করা। বিনিময়ে ধনী নারীরা চুরাইলস গ্রুপকে বড় অংকের ফি দেবেন। সিদ্ধান্ত হয় চুরাইলস গ্রুপ কার্য পরিচালনা করবে বুরকার দোকানের আড়ালে। আগে বুরকা পিছে বন্দুক। গোপনে গ্যাং সম্পর্কে প্রচার করবে নারীদের কাছে।
আগে বুরখা পিছে বন্দুক
বুরকার দোকানের নিচের গোডাউনে তৈরি হল কম্পিউটার ও হ্যাকিং সামগ্রী ও চুরাইল গ্যাং নিয়োগ দিল আরও নারীদের। প্রথম দিকে পরকীয়ায় আসক্ত স্বামীদের নিয়ে কাজ শুরু হলেও মুখোশ পুরুষ, পপতিতাবৃত্তির গ্যাং, অবৈধ গর্ভপাত, নারী অপহরণ, নারীহত্যায় জড়িত বিশাল গ্যাংকে উন্মোচন করে ফেলে চুরাইল নারীরা। হোটেল কক্ষে স্বামীদের পিছু নেওয়া আর বুরকায় আবৃত চুড়াইলদের সশস্ত্র আক্রমণ ছিল অন্যরকম চিত্তাকর্ষক।
নারীবাদের বার্তা
নারীবাদের বিভিন্ন স্তর ও নারী ও নারীর বন্ধুত্বকে যেন খুব কাছ থেকে দেখিয়েছেন ওয়াসিম আব্বাসি। চড়াইলের আসল শক্তি ছিল নারী ঐক্য। সিস্টারহুড। ওয়েব সিরিজে দেখানো ঘটনাগুলো চিবানোর চেয়ে অনেক বেশি কামড়ে দেয়। নারীবাদ, বর্ণবাদ, শ্রেণীবাদ, অভিজাতবাদ সবই যেন মিশে যায়। গল্পের ছল করে ওয়াসিম আব্বাসি প্রসংগ টেনেছেন পুরুষ ও নারীর সমকামী প্রেমেও। আমরা দেখি ধনী বা দরিদ্র নারীর বেদনা কষ্ট ও দুর্বলতা একেবারেই এক ও অভিন্ন। একজন সারা স্বামীর প্রতারণার শিকার, একজন জুবাইদা তার বাবা মায়ের নির্যাতনের শিকার একজন বাটুল তার স্বামীর হাতে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার, একজন জুগনু নিগ্রো পুরুষকে ভালবাসার শাস্তি পেয়েছেন। একজনের দুঃখ অন্যজনের দুঃখের চেয়েও গভীর যেন একজনের গল্প অন্যজনকে ডুবিয়ে দেয়।
১০-পর্বের সিরিজটি একটি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ডিনামাইটের রূপ নেয় এবং এটি সত্যিকার বিস্ফোরণের মতই। এর সংলাপগুলি একটি নারীদের জন্য একটি অদম্য শক্তির মত বিরাজ করে। সবগুলো চরিত্রের বাস্তবিক অভিনয়, ঝরঝরে ডায়ালগ ওয়েব সিরিজটিকে অনেকটাই বাস্তব করে তুলেছে।
পাকিস্তানি নির্মাতার তৈরি ওয়েব সিরিজ পাকিস্তানেই ব্যান?
চুরাইলসের কিছু ভাইরাল ক্লিপ ও আর্টিস্টদের ডায়ালগ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে কট্টরপন্থী দেশ পাকিস্তানে সেটি প্রচণ্ড সমালোচনার শিকার হয়। পাকিস্তানি মিডিয়া রেগুলেটরি বোর্ড সেটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জানিয়ে টুইট করেছিলেন পরিচালক ওয়াসিম আব্বাসি। পরে ভারতের ভিডিয়ো অন ডিমান্ড- জি ভাইভ চ্যানেল সেটিকে অন এয়ারে আনে।