এ শতাব্দীতে এসেওে আমরা কী এটা ধরে নিতে পারি যে কন্যাকে ঠিক ছেলের মত করেই বড় করা হয়। কন্যা বাবার অপার স্নেহ ভালোবাসা পায় একথা ন্যায্য। কিন্তু ন্যায্য শিক্ষাটি কী কন্যা পাচ্ছে? অথবা ঠিক মায়ের মতই বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ সাহচর্য? বাবা ভূমিকা রাখেনই বা কতদূর? আবদার পূরণ করা খেলনা কিনে দেওয়া পর্যন্তই তো! এসব আমরা মায়ের কাছে দাবি করি। মায়ের ভালবাসা হবে সেবামূলক এটাই মীমাংসিত ও প্রত্যাশিত, আর বাবা? বাবা কী কাজ করবেন, কী ভূমিকা রাখবেন? কতটুকু সময় দেবেন পরিবার ও সন্তানের জন্য সেটির মীমাংসা হয় না। পিতা পরিবারে সময় দিলে সেটাকে একটা এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস হিসেবে গণ্য করা হয়। এই যে বাবার ভূমিকা চাওয়া হয় না তবে বাবার মতামত চাওয়া হয় সেটা পিতৃতন্ত্রের ষড়যন্ত্র। কন্যার বাবাও সেই ষড়যন্ত্রের আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যান।
আমরা সবাই জানি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পিতার অর্থ, ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদার উপর নির্ভর করে পরিবার প্রতিষ্ঠা পায়। বলা যায় পরিবার প্রতিষ্ঠানটির মালিক পিতা। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রতিষ্ঠানে মা সম্পর্কের থেকে পেশা বেশি। মায়ের দায়িত্ব মানে মায়ের সেবামূলক দায়িত্ব। প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা মায়ের সাধারণত থাকে না। কন্যা বা পুত্রদের উপর প্রভাব বিস্তার করেন বাবাই। ধরুন আপনি একজন কন্যার পিতা। এবার আমি প্রশ্ন করছি কন্যাকে যদি ‘মা’ নামক ভূমিকায় ক্ষমতাহীন, ব্যক্তিত্বহীন, ফ্রাস্ট্রেটেড অসুখী ও হতাশ সেবাদাত্রী হিসেবে দেখতে না চান তবে কন্যার প্যারেন্টিংয়ের ভার এবার নিজের কাঁধেই তুলে নিতে হবে।
পুরুষ হয়েও জানতে হবে পুরুষতন্ত্রের রাজনীতি ও বিষক্রিয়া
সন্তান গর্ভে আসার সাথে সাথে ‘মা’ নামক একটা পেশা সৃষ্টি হয়ে যায়। ওইদিন থেকে নির্ধারিত হয়ে যায় মায়ের কী কী কর্তব্য। মা সন্তানকে সবটুকু নিঃশেষ করে ভালবাসবেন জীবনের সবগুলো দিন সন্তান লালন পালনের জন্য দিয়ে দেবেন এটাই প্রত্যাশিত ও মীমাংসিত। বাবা ভরণপোষণের অর্থ ব্যয় করবেন ঠিক তার সামর্থ্যমত এর বাইরে বাবার কাছে বেশি কিছু প্রত্যাশা করে না সমাজ। সেটুকুও যখন বাবা করেন না, অপারগতায় বা অনিচ্ছায় অথবা বাবা কতটা ও কীভাবে সন্তানকে ভালবাসবে এটা সমাজের অমীমাংসিত অধ্যায়। দায়িত্বের এই বিন্যাসে আপনার কন্যা একজন হবু সেবাদাসী এবং আপনি একজন মাথা নত করা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। কন্যার বাবা হওয়ার পর আপনাকে অবশ্যই লিঙ্গ রাজনীতির ক্ষতিকর দিকটি বুঝতে হবে। আপনাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে মা কোন পেশা নয়। মা একটি সম্পর্কের নাম।
মেয়ের খেলনাগুলো বদলে দিন
কন্যা কেনো হাড়ি পাতিল আর পুতুল নিয়ে খেলবে? কেন সে মাঠে খেলবে না? কেন সে ক্রিকেট বা ফুটবলে প্রতিযোগীতা করবে না? কন্যা কেন শুনবে সিন্ডারেলা বা শুয়োরানি দুয়োরানির গল্প। কেন তার জন্য বলা গল্পে তাকে বীর হওয়ার স্বপ্ন দেখাবেন না? কন্যার মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার আসল মন্ত্র তো মানসিক বিকাশের সাথে জড়িয়ে। মেয়ের খেলনাগুলো থেকে লিঙ্গ নির্বাচনটি বন্ধ করে দিন। তাকে বিয়ে রান্নার খেলা খেলতে উৎসাহী করার প্রয়োজন নেই।
কেবল প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য যথেষ্ট নয়
আপনি ভেবেছেন ভাল ভাল প্রতিষ্ঠানে মেয়েকে পড়াবেন। তাকে আপনার আর্থিক অবস্থার সবটুকু সুরক্ষা দেবেন। তাইতো? সেটা করবেন কিন্তু জেনে রাখুন সেটি যথেষ্ট নয়। তাকে একজন শক্তপোক্ত মানুষ হিসেবে গড়তে হলে শিশুকাল থেকেই প্যারেন্টিং-এ প্রত্যক্ষ ভূমিকায় থাকতে হবে আপনাকেই। টক দই দিয়ে ত্বক কোমল করার চেয়ে মুক্ত বাতাসে খেলাধুলা করে ত্বকে বাদামী ছাপ পড়ে যাওয়া বেশি স্বাস্থ্যকর সেটা আপনাকেই শেখাতে হবে। সুন্দর হওয়ার চেয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া বেশি জরুরি আপনিই তাকে শেখাবেন।
মেয়ের যখন প্রেমের বয়স
ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া এক কিশোরী মেয়ের রক্ষণশীল মা আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ফেমিনিজমে কী লেখা আছে তিনি জানেন না। কিন্তু তার মেয়ে বারবার বোর্ড এক্সাম ফেল করছে এবং এ নিয়ে দুবার তার এবরশন করতে হয়েছে। মেয়েটির প্রজনন স্বাস্থ্য ভাল নেই। মাঝে মাঝেই ওভার ব্লিডিং হয়। মেয়ে নিজের জীবনের প্রতিষ্ঠা পাবার আগেই স্ব-নির্ভর হওয়ার আগেই শরীর ও সে স্বাধীনতার কথা বলছে। বারবার তাকে কাউন্সেলিং করাতে নিতে হয়। মেয়ের বাবা মেয়েকে অনেক প্রশ্রয় দিতেন যা আবদার করত তাই কিনে দিতেন। ও মেয়েটি মায়ের কথা মানছে না। এটিই ছিল ওই মধ্যবয়সী মায়ের বক্তব্য। পরিবারটিতে মায়ের ভূমিকা অনেক কিন্তু মায়ের প্রভাব কী আছে?
আপনার বুঝতে হবে বাবার ভালবাসা মানেই অর্থনৈতিক নয়। আপনার ভূমিকা একজন মেন্টরের। মেয়েক মিসোজিনিক সমাজকে চিনতে সাহায্য করুন। মেয়েকে বলুন শরীরের স্বাধীনতা মানে অন্য কারুর শরীরী ডাকে সাড়া দেওয়া নয়। শরীর ও মন পরিণত হলেই শরীরের স্বাধীনতাকে অর্থবোধক করা যায়, অপরিণত বয়সে মানুষ নিজের ভালমন্দ বোঝে না সেটা আপনিই তাকে শেখান। ‘বাবা ভীষণ রাগী’ ‘বাবা ভীষণ দাপুটে’ অথবা ‘বাবা মেয়েকে রাজজুমারীর মত রাখেন’ এইসব বালখিল্য সংজ্ঞা থেকে নিজেকে উইথড্র করে কেবল বাবা হোন এবং বাবার ভূমিকায় যান। মেয়েকে বলুন সে কোন রাজকুমারী না। সে মানুষ। তার লিঙ্গ পরিচয়টাই তার আসল পরিচয় নয়। প্রথমে সে একজন স্বাধীন সত্তা স্বাধীন মানুষ লৈঙ্গিক দিক দিয়ে সে নারী। প্রজনন ছাড়া লিঙ্গের কোন সামাজিক ভূমিকা নেই তা তাকে শেখান।
মেয়েকে নিজ পরিবারের গুরুত্ব শেখান
আমার চেনা পুরুষ বন্ধুরা যারা মেয়ের বাবা হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই অতিস্নেহে বলেছেন তারা মেয়ে বিয়ে না দিয়ে ঘর জামাই নিয়ে আসবেন। ওই বাক্যগুলোর সত্যতা কী জানি না তবে কন্যার পিতা হওয়ার, বিয়ে দেওয়ার ওই অনিরাপত্তার অনুভবটুকুকে আমি অনুধাবন করেছিলাম। প্রসংগক্রমে বলি আমার এক পুরুষ বন্ধু বলেছেন, কেবল মেয়ের বাবা হবার পর থেকে যৌন কৌতুক বা নারীবিদ্বেষী বাণী শুনলে তিনি কন্যাকে অনিরাপদবোধ করেন। পিতা স্নেহের আতিশয্যে কন্যার আর্থিক নিরাপত্তার কথা তো ভেবেই রেখেছেন। কিন্তু কন্যাকে শক্ত মজবুত ব্যক্তিত্বের মানুষ তৈরি হল কী? তবে যে পিতারা কন্যাকে আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারবেন না তারা কী বৈবাহিক মজুরই রয়ে যাবে। তাই আমি পিতার স্নেহর থেকে ভূমিকাতেই গুরুত্ব দেব। কন্যার সাথে বন্ধন ও সংযোগ তৈরি করতে হবে আপনাকেই। নারী হিসেবে না মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে শেখাবেন আপনিই। তাকে বলতে হবে তুমি স্বাবলম্বী শুধু নিজের জন্য হবে না তুমি স্বাবলম্বী হবে তোমার পরিবার ও সমাজের জন্য। বৈবাহিক জীবনেও তোমাকে অর্থনৈতিক দায়িত্ব নিতে হবে। আয় মানে মেক আপ কেনার আয় নয় এ কথাটা বোঝাতে পারেন, আপনি, যিনি আজকের কন্যাশিশুর পিতা।
‘বাবা ভীষণ রাগী বাবার সামনে যাই না’, ‘বাবার সাথে ভয়ে কথা বলি না’, ‘বাবা অনেক ব্যস্ত সময় দিতে পারেন না’, ‘বাবা স্কুলের প্যারেন্টস মিটিংএ যেতে পারেন না’। বাবা অনেক কিছু পারেন না এবং অনেক কিছু করেন না সমাজও সেখানে কোন প্রত্যাশা দেখায় না। বাবার কাছে যা কিছু প্রত্যাশিত না বাবার কাছে যে সব দাবি নেই তার সবকিছু ভর করে মায়ের উপর বা ‘মা’ পেশায় নিয়োজিত সেবিকার উপর। তাই বলব বাবার এ স্টেরিওটাইপ ভূমিকা ও সংজ্ঞাকে বদলে দিন।