৫৬ বছর আগে তিনি যখন প্রকৃতিতে নতুন একটি ভাইরাস খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেন তখন সেটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। এটি করোনাভাইরাস। তারই একটি প্রজাতি ‘কোভিড-১৯’ একটি ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে হাঁটু গেড়ে বসতে হয়েছে পুরো বিশ্বকে। পুরো বিশ্বে কোভিড-১৯ একটি আতংকের নাম। যেন একটু অসাবধান হলেই পজিটিভ। মহামারি ছড়িয়ে দেওয়া এই করোনাভাইরাসের কাছে অসহায় বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোও। করোনাভাইরাসকে প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন একজন নারী ভাইরোলজিস্ট। তিনি ডক্টর জুন ডালজিয়েল আলমেইডা।
করোনাভাইরাসকে প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন একজন নারী ভাইরোলজিস্ট। তিনি ডক্টর জুন ডালজিয়েল আলমেইডা।
তার জীবনের শুরুটা কেমন ছিল?
অসাধারণ মেধাবী জুন আলমেইডা জন্মেছিলেন ১৯৩০ সালের ৫ অক্টোবর। খুব সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই অসামান্যা নারী। স্কুলে তিনি সাইন্সে দক্ষতার জন্য পুরষ্কার পেয়েও ইউনিভর্সিটিতে পড়তে পারেননি আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেখাপড়াকে বিদায় জানিয়েছিলেন তিনি। গ্লাসগো রয়েল ইনফর্মারির গবেষণাগারে টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত সেখানেই কাজ করেছিলেন।
১৯৫৪ সালে তিনি এনরিক রোজারিও (হেনরি) আলমেইডাকে বিয়ে করেন। এনরিক ছিলেন শিল্পী। স্বামীও তরুণী কন্যাকে নিয়ে তিনি পাড়ি জমান কানাডায়। সেখানে অন্টারিও ক্যানসার ইনস্টিটিউটে জুন আলমেইডা ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপ নিয়ে তার দক্ষতা দেখিয়ে প্রশংসা কুড়ান। খুব কম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে তিনি পেয়েছিলেন ডক্টরেট উপাধি ও বিজ্ঞানী খেতাব।
করোনাভাইরাস কখন আবিষ্কার করলেন?
গৃহপালিত মুরগীদের মধ্যে করোনাভাইরাস দেখা গিয়েছিল ১৯৩০ সাল বা তারও আগে। সেটি নিয়ে চলছিল গবেষণাও। ১৯৬০ সালে মানবদেহের করোনাভাইরাস দেখা গিয়েছিল। তবে সেটিকে কেউ আবিষ্কার করতে পারেননি। পরবর্তীতে ভাইরলজিস্ট ইসি কেন্ডল, ম্যালকম ব্যয়ন এবং ডেভিড টাইরেল ১৯৬০ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের কমন কোল্ড ইউনিটে নতুন ভাইরাসটিকে আবিষ্কারের চেষ্টা চালান। ঠান্ডা-সর্দির ভাইরাসের ধরন অনুসরণ করে তারা আবিষ্কার করেছিলেন রাইনোভাইরাস, অ্যাডেনোভাইরাস। পরে সেগুলো পরীক্ষা করতে দুজন স্বেচ্ছাসেবীর শ্বাসনালীতে প্রবেশ করানো হয়। তাদের খুব সাধারণ সর্দি সংক্রমণ হয়েছিল পরে ইথার প্রবেশ করিয়ে সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় করা হয়। এরপর তারা ওই ভাইরাসটির কণা প্রেরণ করেছিলেন আলমেইডার কাছে।
১৯৫৪ সালে তিনি তার তরুণী কন্যা ও স্বামীকে নিয়ে কানাডা চলে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে ওন্টারিও ক্যনসার ইন্সটিটিউটে কাজ করেন। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে তার অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে তার বয়স যখন ঠিক ৩৪ বছর বয়সী জুন আলমেইডা যখন নতুন ধরনের ভাইরাসের খোঁজ পাওয়ার দাবি করলেন তখন একটি রিভিউ জার্নালে তা প্রত্যাখ্যান করা হলো। তার ধারণ করা ছবিগুলোতে ভাইরাসের চারপাশে যে স্পাইক বলয় বা মুকুটের মতো দেখা গেল তাকে বিচারকেরা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের নষ্ট হওয়া ছবি বললেন।
পরে ১৯৬৭ সালে লন্ডনের থমাস হাসপাতালে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের ছবির মাধ্যমে আলমেইড়া প্রথম প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব। তিনি দেখিয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রোটিন স্পাইকসহ দেখতে অনেকটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস তবে এটি তা নয়। তিনি ভাইরাসটির নামকরণ করলেন বি-৮১৪ । পরবর্তীতে এটিকে মানবদেহের করোনাভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তার তোলা সেই ছবিটিই ২ বছর পরে জার্নাল অফ জেনারেল ভাইরোলজিতে প্রকাশ করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে স্কটল্যান্ডের আরবেরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাকটিরিওলজির অধ্যাপক ও ওই দেশের বিখ্যাত মাইক্রোবায়োলজিস্ট প্রফেসর হিউ পেনিংটন বলেছেন, ‘মিসেস আলমেইডা আমার মেন্টর ছিলেন। তার কাজ ছাড়া বর্তমান কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করা সম্ভবও হত না। তার কাজটির কারণে ভাইরাস সম্পর্কে আমরা দ্রুত জানতে পারছি। তিনি ছিলেন এক অসামান্য প্রতিভা। তার সুখ্যতি হল—তিনি গবেষণায কাজে যা ছুঁয়েছিলেন তাতেই সফল। যেন পরশপাথর।’
পেনিংটন বলেন, ২০ শতাংশ সাধারণ জ্বর-সর্দি কাশির কারণ করোনাভাইরাস বলে ধারণা করা হয়।
পেনিংটন বলেন, ২০ শতাংশ সাধারণ জ্বর-সর্দি কাশির কারণ করোনাভাইরাস বলে ধারণা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, রুবেলা ভাইরাসের প্রথম ছবিও আলমেইডা তৈরি করেছিলেন। এছাড়াও হেপাটাইটিসবি ও সর্দি-কাশির অনেক ভাইরাস নিয়ে তিনি কাজ করেছেন।
২০০৭ সালে, ৭৭ বছর বয়সে জুন আলমেইডা মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর ১৩ বছর পরে তিনি সেই কাজের জন্য অবশেষে স্বীকৃতি পাচ্ছেন। তার কাজটি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯কে বুঝতে সহায়তা করছে।