মোটরসাইকেলের দুটো চাকাই ছিল তার বেঁচে থাকার মাধ্যম। পিতৃহীন দুই মেয়ে ও অসুস্থ মাকে নিয়ে বাঁচতে তার প্রধান জীবিকা হয়ে উঠেছিল পাঠাও উবার রাইড শেয়ারিং অ্যাপস। করোনার দীর্ঘ লকডাউনে টিকে থাকাটাও খুব কঠিন হয়ে পড়লো। যিনি কখনও কারও কাছে হাত পাতবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাকে করোনায় তাকে খাদ্য সহযোগিতাও নিতে হয়েছে। রাইড শেয়ারিংয়ের অ্যাপস আর ধারের টাকায় কেনা একটি মোটরসাইকেলই ছিল তার আয়ের চাকা। করোনায় অ্যাপসগুলো বন্ধ হওয়ার পর জীবিকা নিয়ে নিদারুণ হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন সারাদেশে নন্দিত ও প্রশংসিত নারী মোটরবাইক চালক শাহনাজ আকতার পুতুল।
শাহনাজ পুতুল বলেছেন, ‘ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি ম্যাডাম আমার মেয়েদের স্কুল ফিস ফ্রি করে দিয়েছেন। এজন্য তার কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার কাছে যারা সাক্ষাতকার চেয়েছিলেন আমি বলেছিলাম— আমি কাজ করেই আয় করতে চাই। যত পরিশ্রমই হোক আমি করব। টাকা পয়সার সহযোগিতা কখনো চাইনি। কারও সাহায্য নিয়ে বাঁচতে চাইনি বলে পরিশ্রমকে এতটুকু ভয় পাইনি। কাজ যত কষ্টসাধ্যই হোক তা আমি করতে পারি। আমার দুটি মেয়ে ও অসুস্থ মায়ের মুখে আমি খাবার তুলে দিতে চাই ও মেয়েদের পড়াশোনাটা চালিয়ে নিতে চাই। জীবিকার প্রয়োজনে মোটরসাইকেল চালিয়ে পাঠাও উবার রাইড শেয়ারিং পেশায় এসেছিলাম। এ কারণে আমি অনেকের হাসির পাত্র যেমন হয়েছিলাম তেমনই আমাকে দেশের অনেক মানুষ সম্মান করেছেন। সেজন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। করোনার দীর্ঘ লকডাউনে বেঁচে থাকার ওই ছোট অবলম্বনটুকুও আমি হারিয়েছি। আমি নিজে কষ্ট করে আমার দুই মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলতে চাই। শিক্ষাগত যোগ্যতা কম বলে ড্রাইভার পদেও একটি চাকরি পাইনি আমি।’
রাইড শেয়ার চালক হিসেবে কীভাবে যুক্ত হলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জীবিকার জন্য আমি অনেক কাজ করেছি। ইনসুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করেছিলাম, চায়ের দোকান দিয়েছিলাম, ওষুধের বোতলে লেবেল লাগানোর কাজও করেছিলাম। আমি কষ্ট করেছি আমার মেয়েদের একটা ভালো ভবিষ্যত দেওয়ার জন্য। আমার এক ভাইয়ের কাছ থেকে জেনে ঋণ করে একটি মোটরসাইকেল কিনে রাইড শেয়ার চালক হিসেবে ঢাকায় কাজ শুরু করি। তা দিয়েই আমি সংসার চালিয়েছি। প্রথম আলোর মনসুরা আপু আমাকে নিয়ে একটি নিউজ করেন, তারপর থেকেই লোকজন আমাকে চিনেছে। ’
করোনায় অর্থকষ্ট প্রসংগে উইম্যান ভয়েসবিডিকে শাহনাজ পুতুল বলেন, ‘করোনার লকডাউনে প্রথমেই অ্যাপসগুলো বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম ১০-১৫দিন এমনি কেটে যায়। এরপর আর যেন টানতে পারছিলাম না। এমন কী খাবার নিয়েও খুব সংকটে পড়ে যাই। বিদ্যানন্দের নম্বরে ফোন করি। তারা আমাকে কয়েকদিনের খাবার পৌঁছে দেয়। এরপর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ‘খাদ্য সহায়তা’ কাজে যুক্ত হলাম। মোটরসাইকেল নিয়ে ওদের খাবারগুলো ডেলিভারি করতাম। বিনিময়ে অল্প টাকা আর দুই তিন দিনের খাবার নিতাম। এভাবেও কিছুদিন পার করেছি। বাসা ভাড়া, খাবার, মেয়েদের লেখাপড়া, ওদের হোম টিউশন ফি কিছুই থেমে থাকেনি। এসব নিয়ে আমি এখন খুব হতাশায় আছি।’
নারী রাইড শেয়ার চালক হিসেবে কাজ করার বিষয়ে শাহনাজ পুতুল বলেন, ‘পুরুষ রাইডাররা ব্যক্তিগতভাবে চুক্তিভিত্তিক যাত্রী পরিবহন করছিলেন। এটি যেহেতু আমারও জীবিকা আমিও তাদের সাথে যাই। লকডাউনের কারণে সড়কে খুব একটা যাত্রী থাকে না। অনেকটা প্রতিযোগিতা করে যাত্রী তুলতে হয়। দেখা গেছে পুরুষ রাইডাররা যাত্রীদের হাত ধরে টেনে বলতে পারে ‘আসেন ভাই, আপনাকে পৌঁছে দিই। টাকা যা হয় একটা দিবেন। ’ কিন্তু নারী হয়ে পুরুষ যাত্রীদের এভাবে প্রতিযোগিতা ও হাত ধরে টেনে তুলে রাইড শেয়ার করাটা নারী হিসেবে খুব অসম্ভব হয়ে পড়েছিল আমার জন্য। অথচ অ্যাপসের মাধ্যমে কাজটি তুলনামূলক সহজ ছিলো। ’
শাহনাজ পুতুল বলেন, ‘সৎভাবে কাজ করে খেতে চেয়েছি বলে সাহসের সাথে রাইড শেয়ার চালক হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেছিলাম। কারও বিদ্রপের হাসি বা নেতিবাচক মন্তব্যে পেছনের ফিরে তাকাইনি। সংবাদ মাধ্যমে আমার খবর প্রচারিত হওয়ার পর এমপি ও বড় সংগঠন আমাকে চাকরি দিয়ে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। করোনার বন্ধের কারণে হয়ত সেটি তারা করতে পারেননি। ব্র্যাকে ড্রাইভার পদে চাকরির চেষ্টা করেছিলাম ১৫ হাজার টাকা বেতনের। সে চাকরিটি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে আমি আর পাইনি। বারবার আশাহত হয়েছি আমি ভেঙ্গে পড়িনি। ’
অশ্রুসিক্ত হয়ে শাহনাজ পুতুল বলেন, আমি পরিশ্রম করতে রাজি। রাইড শেয়ার চালক হিসেবে পরিশ্রম করার সুযোগটাও করোনার কারণে বন্ধ। কারও কাছে হাত পাততে চাই না। উইম্যান ভয়েসবিডির মাধ্যমে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটা কাজের সুযোগ চাই। আমি ড্রাইভিং শিখেছি। একটি চাকরি বা একটি ট্যাক্সি ক্যাব যদি ঋণের মাধ্যমেও ব্যবস্থা করে দেন সেটি চালিয়ে আমি জীবিকা নির্বাহ করতে পারব। আমাকে একটি সুযোগ দিন আমি আমার মেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে এদেশের একজন যোগ্য ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমি খুব আশা করেছিলাম প্রধানমন্ত্রী একদিন আমাকে ডাকবেন। আমি সাহায্য চাইব না। একটি কাজ চাাইব শুধু।
উল্লেখ্য, জীবন সংগ্রামে হার না মানা নারী শাহনাজ পুতুল পড়াশোনা করেছেন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। রাজধানীর মিরপুরে জন্ম তার। বাবা নেই, মা আর বোনরা আছেন। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর দুই মেয়ে ও মাকে নিয়ে তার সংসার। তার বড় মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে ও ছোট মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। তিনি রাইড শেয়ারে চালক হিসেবে কাজ করছেন প্রায় দুই বছর। এ জানুয়ারিতে তার স্কুটিটি চুরি হওয়ার সংবাদের পর তিনি দেশজুড়ে পরিচিত ও নন্দিত হন।