নারী কেন কাজি হয়ে পুরুষলোকের বিয়ে পড়াবে?
নারী কেন পুরুষলোকের অপরাধের বিচার করবে?
নারী কেন চাকরি করবে?
নারী কেন নেতৃত্ব দেবে?
কোরআনে পুরুষ কী নারীর উপরে অধিষ্ঠিত? কর্তা, অভিভাবক বা শাসক? নারী কী পুরুষের দাসী বা আনুগত্যকারিনী? কী আছে কোরআনে?
শুরুতে বলি কয়েকদিন আগে একজন স্কলারের লেখা পড়লাম। তিনি লিখেছেন, কুরআন যদি কেউ সঠিক অর্থ বুঝে পড়ে এবং তারপর যদি পৃথিবীতে ‘ইসলাম’-এর নামে প্রচলিত বিধানগুলি পড়ে, তাহলে তাঁর মনে হবে দুটো ‘ইসলাম’ পরস্পরবিরোধী।
কোরআনকে আমাদের সামনে কীভাবে উপস্থাপন করা হয়?
কোরআনের বাংলা অনুবাদ ও তাফসিরে নারীকে অনেকটাই পুরুষের অধীনত বলে ব্যখ্যা করা হয়। তার সাথে যুক্ত হন আমাদের দেশের অল্প ধর্ম শিক্ষা পাওয়া ওয়াজকারীরা। কেউ জেনে কেউ না জেনে নারীকে দাড় করিয়ে দেন পুরুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে। কিন্তু আদৌ কী এসব কথা বলা হয়েছে কোরআনে?
আজ আমি নারী সম্পর্কে মিথ্যে ও বিভ্রান্তি ছড়ানো কিছু আয়াত নিয়ে লিখছি
সুরা নিসা আয়াত ৩৪
সুরা নিসা নিয়ে সবচেয়ে বেশি মিথ্যে তথ্য ছড়ানো হয় নারী পুরুষের বা স্বামীর আনুগত্য করবে। স্বামী হল নারীর অধিকর্তা। পবিত্র কুর’আনের সুরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর রিজালু ‘ক্বাওয়ামুনা’ আলান নিসা।’
সুরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতটি মূলত স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক রেসপনসিবিলিটি নিয়ে আলোচনা করেছে। এই আয়াতের ইংরেজি অনুবাদ- ‘Men are the protectors/defenders/supporters of women”. (Qur’an 4:34)’ এখানে বলা হচ্ছে, স্বামী হবে স্ত্রীর ‘ক্বাওয়ামুনা’, অর্থাৎ protector/defender/supporter.
এটি সরাসরি আক্ষরিকভাবেই স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্বকে নির্দেশ করে কর্তা বা মালিকানা নয়।
সুরা মাইদার ৮ নম্বর আয়াত
পবিত্র কুর’আনের সুরা মাইদার ৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে-“ইয়া আইয়ুহা আল্লাযিনা আমানু! কুনু ‘ক্বাওয়ামিনা’ ইলাল্লাহি”। এই আয়াতের ইংরেজি অনুবাদ করা হয়ঃ “O you who believe! Stand out firmly for Allah”. (Qur’an 5:8)। এখানে ঈমানদারদেরকে বলা হচ্ছে, আল্লাহ্র ‘ক্বাওয়ামিনা’ হতে, অর্থাৎ আল্লাহ্র পক্ষ হয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে; ন্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা করতে। স্ত্রীকে ডিফেন্ড করা মানে তাকে অর্থনীতিক ও সামাজিক উভয়ভাবে ডিফেন্ড করা।
সুরা তাওবার ৭১ নম্বর আয়াত
সুরা তাওবার ৭১ নং আয়াতে বলা হয়েছে-“The believers men and women are guardians/protectors of one another.” (Qur’an 9:71)
– এখানে বলা হচ্ছেঃ ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার নারী একে অন্যের ‘আউলিয়া’। ‘আউলিয়া’ হচ্ছে ‘ওয়ালি’র বহুবচন। এই আউলিয়া শব্দের অর্থই হল ‘authority’, ‘custodian’, ‘protector’, ‘ally’.
তার মানে দেখুন কুর’আন অনুযায়ী, তামাম ঈমানদার পুরুষ এবং নারী, একে অন্যের অথোরিটি, অভিভাবক, রক্ষাকারী, সহযোগী।
প্রথমে উল্লেখ করা দুই আয়াতে
‘ক্বাওয়ামুনা’/’ক্বাওয়ামিনা’ শব্দটি এসেছে ‘ক্বামা’ থেকে। ‘ক্বামা’ শব্দের অর্থঃ ‘কোনোকিছুর জন্য দাঁড়ানো’। আর এই ‘ক্বওয়ামুনা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে- কোনোকিছুর পক্ষে যে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায় বা সমর্থন করা।
এখন দেখুন সুরা নিসা’র বেলায় এই শব্দের বাংলা অনুবাদ কী করা হয়?
পুরুষ নারীর উপর কর্তৃত্বশীল।
পুরুষ নারীর কর্তা”। ইংরেজিতে দাড় করালে যেটা হয় ‘অথোরিটি’ বা ‘ইনচার্জ’।
এই ভুল অনুবাদের উপর যখন তাফসির করা হয় তখন আরও জোরেশোরে বুঝানো হয়-এই ‘অথোরিটি’ যেমন তেমন অথোরিটি না অ্যাবসুলিউট অথোরিটি। স্বামী যতই শয়তানের হাড্ডি হোক সুরায় উল্লেখ করা ওই আনুবাদিক কর্তৃত্বের জোরে সে নিজের ধার্মিক স্ত্রীর উপরও আধিপত্য বিস্তারের অধিকারী।
এসব তাফসিরে এমন কি শুধু স্বামীকে বা এই কর্তৃত্বের জোর তুলে দেওয়া হয় আপামর পুরুষকে। সব পুরুষ সব নারীর ‘কর্তা’ হয়ে যায়। এই কর্তৃত্বের জোরে তামাম পুরুষজাতি তামাম নারীজাতির উপর সুপিরিওর হয়ে যায়। এই কর্তৃত্বের জোরে কোনো মেয়ে যতই দ্বীনদার, মেধাবী, আলেমা হোক, সে ‘কাজি’ হওয়ার যোগ্যতা হারায়। কারণ দুনিয়ার পুরুষেরা তাঁর অভিভাবক; তাঁর উপর সব পুরুষের অথোরিটি আছে।
নারী কেমনে পুরুষলোকের বিয়ে পড়াবে?
নারী কেমনে পুরুষলোকের অপরাধের বিচার করবে?
এসব তাফসিরকারী কেউ কিছু বলতে আসলেই এই এক আয়াত ধরিয়ে দেওয়া হয়। ব্যাস, কেল্লা ফতে! ‘ক্বাওয়ামুনা’ শব্দের অর্থ ‘কর্তা’। পুরুষ নারীর উপর ‘কর্তৃত্বশীল’।
এখন দেখুন ক্বাওয়ামুনা শব্দের অর্থ যদি কতৃত্বশীল হওয়া বোঝায় তবে সুরাহ মায়িদায় যখন ঈমানদারদেরকে বলা হচ্ছে, আল্লাহ্র ‘ক্বাওয়ামুনা’ হতে, তখন তাহলে ব্যাপারটা আসলে কী দাঁড়ায়?
– “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্র ‘কর্তা’ হও”।
– “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্র উপর ‘অথোরিটি’ হও”।
– “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্র ‘অভিভাবক’ হও”।
কিন্তু যেই না ঈমানদারগণ বিয়েশাদী করতে বসে, ওমনি না কি একজন ‘ওয়ালি’ লাগবে এবং ওয়ালিকে অবশ্যই ‘পুরুষ’ হতে হবে। মেয়েলোক সে যতই দ্বীনদার, এলেমদার হোক, সে বিয়ের ‘ওয়ালি’ হতে পারবে না।
আল্লাহ্ কুর’আনে বলে দিলেন, ঈমানদার নারী, ঈমানদার পুরুষের ‘ওয়ালি’। আর আমাদের বাংগাল সমাজের ‘ইসলাম’ বলে দিল, মেয়েলোক ‘ওয়ালি’ হতে পারবে না।
আসুন চক্ষু খুলে আবার দেখি, কুর’আনের আয়াত অনুযায়ী ব্যাপারটা কী দাঁড়াইলোঃ
– তামাম ঈমানদার পুরুষ এবং নারী, একে অন্যের অথোরিটি, অভিভাবক, রক্ষাকারী, সহযোগী, (আউলিয়া)। ____(Qur’an 9:71)
– পুরুষ (স্বামী) নারীর (স্ত্রীর) রক্ষাকারী, সহায়তাকারী, সমর্থক, পৃষ্ঠপোষক, (‘ক্বাওয়ামুনা’)। ____(Qur’an 4:34)
– ঈমানদারগণকে বলা হয়েছে, আল্লাহ্র পক্ষ হয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে, ন্যায়কে সমর্থন করতে (‘ক্বাওয়ামিনা’)। ____(Qur’an 5:8)
দেখা যাচ্ছে আল্লাহ্র পক্ষ হয়ে ঈমানদারদেরকে যেভাবে সাপোর্ট করতে বলা হয়েছে একইভাবে স্ত্রীদের পক্ষ হয়ে স্বামীদেরকে সেই একই আচরণ করতে বলা হয়েছে।
সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতের ‘কানিতাত’ শব্দের অর্থ ‘স্বামীর প্রতি আনুগত্য’ বলে যারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে, তাঁরা কিন্তু এখন ভেজালে পড়ে যাচ্ছে। একদল জ্ঞানী এখন ওই পয়েন্টে শক্ত করে ধরে বসেছেঃ “মেয়েদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ‘স্বামীর’ প্রতি আনুগত্য করতে; শ্বশুর-শাশুড়ি/শ্বশুরবাড়ীর প্রতি না”…।
সূরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে মেয়েদেরকে আসলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘আল্লাহ্র’ প্রতি আনুগত্য করার জন্য। এই ‘কানিতাত’ শব্দটা দিয়ে কুর’আনের প্রত্যেকটা জায়গায় ‘আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য’ বুঝিয়েছে; কোনো মানুষের প্রতি নয়।
এখন, আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্যেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হচ্ছে, দাম্পত্যজীবনে সঙ্গীর প্রতি অনুগত্য। এই আনুগত্য দাসত্ব নয় বিশ্বস্ত বা লয়াল থাকা। আর দাম্পত্যজীবনে সঙ্গীর প্রতি লয়াল/অনুগত/বিশ্বস্ত থাকা শুধু স্ত্রীর নয় স্বামীরও কর্তব্য। নারী-পুরুষ সবার জন্যই যে দাম্পত্যজীবনে সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত/অনুগত/লয়াল থাকা ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ দাবি সেটুকু আমরা সবাই জানি।
এবার দেখুন শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের প্রতি সদয়, ন্যায়সঙ্গত, সুবিবেচনাপূর্ণ ব্যবহার করাও কি আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্যের পার্ট নয়?
অবশ্যই! তাঁরা আপনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তাঁদের হক আদায় করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। আর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের প্রতি এই সদয়, ন্যায়সঙ্গত, সুবিবেচনাপূর্ণ ব্যবহার করা, স্বামী-স্ত্রী দু’জনের বেলাতেই প্রযোজ্য। কেবল স্ত্রীর জন্য নয়। সেটা আমরা রাসুল (সাঃ)-এর সুন্নাহ থেকেও অনেকটা দেখতে পাই।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ‘কানিতাত’ হোন; অর্থাৎ আল্লাহ্র প্রতি অনুগত হোন। আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্যের অংশ হিসেবে, স্বামী/স্ত্রীর প্রতি লয়াল/অনুগত/বিশ্বস্ত হোন।
এবং আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্যের অংশ হিসেবেই, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের প্রতি সদয়, ন্যায়সঙ্গত ও সুবিবেচনাপূর্ণ হোন।
আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন কুর’আনকে বলেছেন, ‘আল ফুরক্বান’; অর্থাৎ ‘সত্য ও মিথ্যার নিশ্চিত পার্থক্যকারী’। রাব্বুল আ’লামীন যেন আমাদেরকে পবিত্র কুর’আনের সাহায্যে, সত্য ও মিথ্যার নিশ্চিত পার্থক্য করতে পারার তাওফিক দেন।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আইওয়াতে গবেষণারত