‘ক্যানভাস ম্যাগাজিনের ফটোশুট নারীবিদ্বেষের চরম রুপ’- ৩১ নারীবাদীর বিবৃতি
সম্প্রতি পদ্মিনী, হস্তিনী, চিত্রিণী ও শঙ্খিনী নারীকে বর্ণনা করে আলোকচিত্র ও ফিচার প্রকাশ করেছে লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন হিসেবে খ্যাত ক্যানভাস পত্রিকা। সেটি ১৭ শতকের কবি ভারতচন্দ্র গুণাকরের কবিতা ’স্ত্রীজাতি কথন’-এ উল্লেখিত নারীর চিত্রায়ণ ও বর্ণনা। ক্যানভাসে প্রকাশিত ওই ফিচারটিকে নারীর প্রতি চরম অসম্মানজনক, নারীবিদ্বেষী ও পুরুষতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশের ৩১ নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট।
এর আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিষয়টি সবার নজরে আনেন নারীবাদী অ্যাকটিভিস্ট ও নারীবাদী পোর্টাল ফ্যমিনিস্ট ফ্যাক্টরের সম্পাদক মুনমুন শারমিন শামস। এরপরই ফেসবুকে এ নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছেন নারীবাদী অ্যাটিভস্টরা।
ক্যানভাসের ওই ফটোশুট নারীবিদ্বেষের চরম রুপ উল্লেখ করে নারীবাদীদের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘১৭ শতকের কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের তৎকালীন সামাজিক ও মানসিক চেতনার প্রেক্ষাপটে লেখা এই চরম পুরুষতান্ত্রিক, নারীবিদ্বেষী, ভোগবাদী কবিতাটিকে নতুন করে কেন সামনে আনা হলো সেটি নিয়ে ভেবে দেখবার আছে বলে আমরা মনে করি। এর পেছনে কোনো পক্ষের কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখবার কারণ রয়েছে। এই একবিংশ শতকে নারীর প্রতি এই চরম জাতিবিদ্বেষ, বডি শেমিংভিত্তিক পদ্যকে মহিমান্বিত করে তুলে ধরবার পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে একটি গণমাধ্যমের এদেশের নারীরা তা জানতে আগ্রহী। ’
এতে বলা হয়, ‘আমরা যারা নারীবাদী আন্দোলনে সম্পৃক্ত, তারা আশংকা অনুভব করছি এই ভেবে যে, কোনো একটি অসৎ মহল অসৎ উদ্দেশ্যে নারীর অগ্রযাত্রা, কুপ্রথা ভাঙ্গবার লড়াই ও মাথা উঁচু করে চলবার জন্য অর্জিত সাহস, মনোবল ও আত্মবিশ্বাসকে ভেঙ্গে দিতে তৎপর হয়েছে। নারীর প্রতি এ ধরনের মনোভাব পোষণকারী কবিতাকে নতুন করে সামনে এনে এই পুরুষতান্ত্রিক, ন্যাক্কারজনক মনোভঙ্গি ও চেতনা তোষণকারী গণমাধ্যম- ক্যানভাসের এ ধরনের আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে নারীবাদী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মীরা। অবিলম্বে ক্যানভাস কর্তৃপক্ষকে এই ফিচার প্রকাশের দায়ে ক্ষমা চাইবার আহ্বান জানানো হচ্ছে। সেইসাথে আমাদের দাবি ক্যানভাসের অনলাইন সংস্করণ থেকে লেখাটি তুলে নিতে হবে। একইসাথে ভবিষ্যতে এ ধরনের সেক্সিস্ট, বডি শেমিংমূলক কন্টেন্ট প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে সতর্ক থাকবারও অনুরোধ জানানো হচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করছি, নারীর অগ্রযাত্রা, লিঙ্গ সমতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় এদেশের প্রতিটি গণমাধ্যম ভবিষ্যতে আরো প্রগতিশীল ও সংবেদনশীল আচরণ করবে।’
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও লিঙ্গ সমতা ও বৈষম্যহীনতার লক্ষ্যে যে বৈশ্বিক যাত্রা তা থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে এই বাংলাদেশ। দেশে নারীর প্রতি অবমাননা, নির্যাতন ও বঞ্চনা অপমানের যে করুণ চিত্র আমরা দেখতে পাই, তাতে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কিংবা স্বপ্ন দেখবার সুযোগ নেই। তবুও, এই নিদারুন প্রতিকূলতার ভেতরেও, নারী পুরুষ ও সব লিঙ্গের মানুষের জন্য একটি সমতার পৃথিবী গড়তে এবং বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করছেন এদেশের নারীবাদীরা। এদেশে নারীবাদ আন্দোলন ধীরে এগুলেও বর্তমানে তা জোরালো হয়ে উঠছে। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য নারীর প্রতি সকল অবিচার, অন্যায়, বৈষম্য ও অবমাননা দূর করা। আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন, গোঁড়ামীপূর্ণ সমাজে এই ধরনের মানবিক বোধ প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন। তবু সেই কাজটি যে যার অবস্থান থেকে করে যাচ্ছেন। ’
ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা জানি, যে কোনো সমাজ বদলে একটি দেশের গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর প্রতি অবমাননা ও অবিচার দূরীকরণে গণমাধ্যমের প্রগতিশীল চিন্তা ও পদক্ষেপ সবসময়ই জরুরি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা, বাংলাদেশে নারীবাদ আন্দোলনের সাথে জড়িত কর্মীরা, লক্ষ্য করছি যে, বেশ কিছুকাল ধরেই এদেশের বেশ কিছু মূলধারার গণমাধ্যম নারীর প্রতি অবমাননাকর ফিচার, রিপোর্ট, ফটো ইত্যাদি প্রকাশ করে চলেছে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে দেখছি যে, যেখানে ক্রমশ আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলবার কথা, সেখানে নানারকম কন্টেন্ট তৈরি ও প্রকাশ হচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমে, যে কন্টেন্টগুলো সরাসরি নারীর প্রতি চরম অপমান, অবমাননার পক্ষে অরুচিশীল বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। ’
বিবৃতি প্রদানকারী ৩১ নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্টরা হলেন
১।সুপ্রীতি ধর
২।শারমিন শামস্
৩।কাবেরী গায়েন
৪।স্নিগ্ধা রেজওয়ানা
৫।ফারহানা হাফিজ
৬।কাশফিয়া ফিরোজ
৭।আফসানা কিশোয়ার লোচন
৮।তাসলিমা মিজি
৯।নাহিদ সুলতানা
১০।দিলশানা পারুল
১১।গীতি আরা নাসরিন
১২।প্রমা ইসরাত
১৩।লাকী আক্তার
১৪।অপরাজিতা সঙ্গীতা
১৫।মাহা মির্জা
১৬।ইশরাত জাহান ঊর্মি
১৭।নাহিদ আক্তার
১৮।কানিজ আকলিমা সুলতানা
১৯।ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী
২০।শাশ্বতী বিপ্লব
২১।জান্নাতুন নাঈম প্রীতি
২২।নাহিদা আক্তার
২৩।অরণি আঞ্জুম
২৪।ফাহমিদা হানিফ ইলা
২৫।মেহেরুন নূর রহমান
২৬।ক্যামেলিয়া আলম
২৭।হাবিবা রহমান
২৮।মিতি সানজানা
২৯।বীথি সপ্তর্ষী
৩০।শাহাজাদী বেগম
৩১।মারজিয়া প্রভা
কবি ভারতচন্দ্রের যে কবিতাটি নতুন করে সমালোচিত হচ্ছে তা হল
স্ত্রীজাতি কথন
পদ্মিনী
নয়নকমল, কুঞ্চিত কুন্তল, ঘন কুচস্থল, মৃদু হাসিনী।
ক্ষুদ্র রন্ধ্রানাসা, মৃদু মন্দ ভাষা, নৃত্যগীতি আশা সত্যবাদিনী।
দেবদ্বিজে ভক্তি, পতি অনুরক্তি, অল্পরতিভক্তি, নিদ্রাভোগিনী।
সুললিতকায়, লোম নাহি হয়, পদ্মগন্ধ কয়, সেই পদ্মিনী।
হস্তিনী
স্থূল কলেবর, স্থূল পয়োধর, স্থূল পদকর ঘোরনাদিনী।
আহার বিস্তর, নিদ্রা ঘোরতর, বিহারে প্রখর পরগামিনী।
ধর্ম্ম নাহি ডর, দন্ত ঘোরতর, কর্ম্মেতে তৎপর মিথ্যাবাদিনী।
সুপ্রসস্থ কায়, বহু লোম হয়, মদ গন্ধ কয় সেই হস্তিনী
চিত্রিণী
প্রমাণ শরীর, সর্ব্বকর্ম্মে স্থির, নাভি সুগভীর, মৃদুহাসিনী।
সুকঠিন স্তন, চিকুর চিকণ, শয়ন ভোজন মধ্যচারিণী।
তিন রেখাযুত, কণ্ঠ বিভূষিত, হাস্য অবিরত মন্দগামিনী
কমনীয় কায়, অল্প লোম হয়, ক্ষারগন্ধ কয় সেই চিত্রিণী
শঙ্খিনী
দীঘল শ্রবণ, দীঘল নয়ন, দীঘল চরণ, দীঘল পাণি।
সুদীঘল কায়, অল্প লোম হয়, মীনগন্ধ কয়, শঙ্খিনী জানি
সমালোচিত ছবিগুলো
এফএ/উইম্যানভয়েস