‘যৌতুকের কথায় কথায় অশ্রাব্য গালি ও ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছি স্বামী ডা. কামনাশীষ চক্রবর্তী সেতু ও তার পুলিশ কর্মকর্তা পিতা নির্মলেন্দু চক্রবর্তী ও তার মা শিখা চক্রবর্তীর। চুল কেটে দেওয়া, শরীরে গরম পানি ঢেলে দেওয়া, খুন্তি দিয়ে ছ্যাকা দেওয়াসহ ভয়ানক নির্যাতন করেছে আমার উপর। কেবল ৮০ লাখ টাকার ফ্ল্যাটের দাবিতে। বারবার সহ্য করে গেছি মেয়েটির জন্য সংসার টেকাতে চেয়েছি। পড়াশোনা করেও তাদের কথা রাখতে চাকরিও ছেড়েছি তবুও তারা আমার ক্ষমা করেনি।’—কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৭-এ ১১(গ) ধারায় দায়ের হওয়া মামলার বাদি বৈশাখী ভট্টচার্য।
গত ২৫ মে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের অভিযোগ এনে স্বামী ডাক্তার কামনাশীষ চক্রবর্তী, শ্বশুর নির্মলেন্দু চক্রবর্তী ও শাশুড়ি শিখা চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৭-এ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ ধারার গ অনুচ্ছেদের অধীনে মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী নারী বৈশাখী ভট্টাচার্য।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, ’গত ২৩ মে রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ হেল্পলাইন নম্বর ৯৯৯-এ ফোন দিলে নগরীর কোতোয়ালী থানার রহমতগঞ্জ এলাকার বিলকিস ভবন থেকে ভিকটিম নারীকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। অবস্থা আশংকাজনক হওয়ায় থেকে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক) প্রেরণ করা হয় ভুক্তভোগী নারীকে।’
মামলার বরাত দিয়ে ভুক্তভোগী নারী বলেন, ’২০১৭ সালের ২৮ এপ্রিল আমার সাথে ম্যাক্স হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার কামনাশীষ চক্রবর্তীর সাথে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের আলাপের সময় আমার শ্বশুর আমার বাবাকে আসবাব, তৈজসপত্র ও স্বর্ণালংকারের জন্য বিভিন্নভাবে চাপ দেন। আমার বাবা সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকেন। তারা একটির পর একটি দাবি করতে থাকে। আমার বিয়ের চারটি অনুষ্ঠানই ধুমধাম করে করতে হয় বাবাকে। বিয়ের সময়ই বাবা জমি বিক্রি করে দিয়ে তাদের আবদার পূরণ করতে থাকেন। বাবার ৫০ লাখ টাকা খরচ হয় আমাকে বিয়ে দিতে। তারা বারবারই বলত ‘আর ফোয়া ডাক্তার’ ’অনর মাইয়া সুখত থাকিবু’। তিনমাস মোটামোটি ছিলাম। আমার উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু হয় বিয়ের তিনমাসের মাথায়।’
ভুক্তভোগী নারী বলেন,’ বিয়ের তিনমাস পর আমাকে আমার শ্বশুর শাশুড়ি বলেন, বাবাকে যেন বলি ফ্ল্যাটের কথা। ৮০ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট কিনে দিতে হবে। আমি কোন উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাই। তখন থেকে আমার শাশুড়ি আমাকে অকারণে ‘মা-’, ’খা-কি’ এরকম শব্দ ব্যবহার করে গালিগালাজ করতেন। আমার শাশুড়ি কাজের মেয়েদের পেটাতেন। আমাকে পেটাতেন আরও ঘৃণা নিয়ে। গ্রামের আত্মীয় আমার চুল সুন্দর বলায় আমার চুল কেটে দিয়েছিলেন এলোমেলো ও ছোট করে। গরম খুন্তি দিয়ে প্রায় ছ্যাকা দিতেন। সেসবের চিহ্ন এখনও আমার শরীরে আছে। শুধু ফ্ল্যাট পাওয়ার জন্য আমার শাশুড়ি আমার হাঁটুর ওপরে গরম পানি ঢেলে দিয়েছিলেন। আমি তখন অন্তসত্ত্বা। তারা চাইতো আমি এসব কথা বাবাকে বলি। তারা ভাবতো বাবাকে বললে বাবা মেয়ের সুখের জন্য হয়তো ফ্ল্যাট কেনার টাকা দিয়ে দেবেন। কিন্তু আমি বাবাকে কিছু জানাই না। এতে তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।’
মামলার বরাত দিয়ে ভুক্তভোগী নারী বলেন, ‘তখন আমি ৬ মাসের অন্তসত্ত্বা। হঠাৎ একদিন আমার স্বামী কামনাশীষ, আমার শাশুড়ি শিখা ও শ্বশুর নির্মলেন্দু আমার উপর চড়াও হন। আমাকে বলেন, আমরা ইন্ডিয়া যাব। তুই বাপের বাড়ি যা। আমরা ফিরতেই ফ্ল্যাটের টাকা আনবি। তা না হলে আমরা ছেলের জন্য আবার বউ আনব। আমার শাশুড়ির কথা, আর ফোয়া ডাক্তর, বউত ফইসাঅলার মাইয়া আনিত ফাইরগম ‘ মানে আমার ছেলে ডাক্তার অনেক ধনী ঘরের মেয়ে আনতে পারব। আমি যৌতুকের দাবিতে সম্মতি না দিলে ওরা সবাই মিলে আমাকে অন্তসত্ত্বা অবস্থায়ই মারধর করতে থাকে। একপর্যায়ে আমাকে আমার শাশুড়ি শুধু মোবাইল ফোনটা দিয়ে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের করে দেন। যাওয়ার সময় বলেন, স্বর্ণ ও মূল্যবান আসবাবের কথা যেন ভূলে যাই। ওগুলো নাকী এখন তার। আহতাবস্থায় আমি বাবার বাড়িতে ফেরত যাই।’
ভুক্তভোগী নারী বলেন, ‘এরপর আমার সন্তান ডেলিভারির দিন আসন্ন হলে আমি ম্যাক্স হাসপাতালে যাই চেকআপের জন্য। সেখানে আমার শ্বশুর আমাকে বাসায় পৌছে দেওয়ার কথা বলে তাদের বাসায় নিয়ে যায়। এবং বাসার গেটেই আমাকে মারধর করতে করতে আমার কাছে সাদা কাগজে সই চায়। আমার স্বামী আমাকে চড় দিচ্ছিলেন, শ্বশুর ঘুষি আর শাশুড়ি আমার পেটে লাথি মেরে যাচ্ছিলেন। আমি ভাবিনি ওই অবস্থায় কোন মানুষ কোন নারীকে এভাবে পেটাতে পারে। এলাকার সবাই দেখছিল ঘটনাটি। তাদের মধ্যে কেউ আমার বাবাকে ফোন দিলে বাবা ঘটনাস্থলে আসেন। সেখানে তারা বাবার কাছেও সাদা কাগজে সই চান। বাবা সাদা কাগজে সই দেবেন না জানিয়ে আমার জেঠুকে ডেকে এনে আমাকে নিয়ে যান। ওইদিন ছিল ২০১৮ সালের ১৭ মে। ওই ঘটনার পর আমি আদালতে মামলা দায়ের করি। ওই মামলা তদন্তের ভার পড়ে পিবিআইয়ের উপর। আমার পুলিশ কর্মকর্তা শ্বশুরের প্রভাবের কারণে তারা আমার বিপক্ষে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। এ বিষয়ে আমি মহামান্য হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেছি। এরপর আমার সন্তানের ভরণপোষণ ও দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মামলা দায়ের করি চট্টগ্রামের পারিবারিক আদালতে। এভাবেই কেটে গেছে তিনটি বছর। ওই পরিবার আমার বা মেয়ের কোন খোঁজ নেয়নি কোন ভরণপোষণ দেয়নি।
ভুক্তভোগী নারী আরও বলেন, ২০২১ সালের ১ অক্টোবর আমার স্বামীর পরিবার ও আমার পরিবারের মধ্যে একটি আপস চুক্তি হয়। ওই সময় তারা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে সংসার করবে বলে চুক্তি করে। এরপর গত মে মাসের ৬ তারিখে আমি স্বামীর সাথে নতুন বাসায় উঠি। সেখানে গিয়ে দেখি আমার বাবার পাঠানো বেশিরভাগ আসবাব ওখানে আনেনি সে। কয়েকদিনেই আমি বুঝতে পারি এ বাসাটি সে সংসার করার জন্য নেয়নি। কারণ সে বাজার করত না। করলেও এমনভাবে করত যাতে দুযেকদিনে ফুরিয়ে যায়। এছাড়া সে প্রায় বাসায় থাকত না। একদিন শ্বশুর শাশুড়ি এসে আবারও সংসার করার ইচ্ছা থাকলে ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা বলে ও গালাগাল করে চলে যায়। ওইদিন মারধর করেনি। ২২ তারিখে সে বাসায় আসেনি ২৩ তারিখ রাতে বাসায় ফিরেই আমাকে অতর্কিতভাবে চড় দিতে শুরু করে। আমি সেখান থেকে সরে গেলে এসে আমাকে লাথি দিতে থাকে। এরপর সার্জিক্যাল ছুরি দিয়ে আমার হাত কেটে দেয়। আমার প্রচণ্ড ব্লিডিং হচ্ছিল। এক পর্যায়ে সে তার বাবাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘ অ বাবা এহন আইয়ু, চো-নির ঝিরে আজিয়াই মারি ফালাইয়ম।’ আমি তৎক্ষণাৎ ৯৯৯ এ ফোন দিই। আমি ফোনের লাইন কাটার আগেই হুড়হুড় করে ঘরে ঢোকেন আমার শ্বশুর ও শাশুড়ি। এসেই আমার জামা কেটে দেন যাতে আমি পালাতে না পারি। এরপর আমার শ্বশুর ও আমার স্বামী আমার গলা টিপে ধরেন ও আমার শাশুড়ি আমাকে ইট দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। এ সময় তারা আমার মেয়েকেও আঘাত করে। আমার শ্বশুর আমার হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নেন। আমি চিৎকার করলে বাসার দারোয়ানসহ প্রতিবেশীরা সেখানে চলে আসে। তারও কিছুক্ষণ পর আসে পুলিশ। পুলিশ এসে আমাদের থানায় নিয়ে যায়। থানা থেকেই বাবাকে ফোন করা হয়। বাবা এসে আমাকে চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতাল নিয়ে যান। আমি ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে দুদিন চিকিৎসা নিই। ২৫ তারিখে আমি হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে বাসায় চিকিৎসাধীন রয়েছি।
উইম্যানভয়েসবিডির প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে ভিকটিম নারী বলেন, ‘আপু মার খেয়েছি সহ্য করেছি মেয়ের জন্য। সংসার টেকাতে চেয়েছি মেয়ের জন্য। আমার মেয়ের উপর যখন আঘাত এসেছে তখন আমার পুরো পৃথিবী এলোমেলো লেগেছে। শুধু ভেবেছি আর সহ্য করব না। ওরা যেন আর কোন পরিবারের নারীর ক্ষতি করতে না পারে। আমার বাবার দেওয়া উপহার ও স্বর্ণ আমি ফেরত চাই। আমি ন্যায়বিচার চাই।’
আজ রোববার (৫ জুন, ২০২২) এ রিপোর্ট লেখা শেষে সূত্র মারফত জানা যায়, ভুক্তভোগী নারীর স্বামী বাদি হয়ে পেনাল কোডের ধারা ১৪৩, ৩২৩,৩২৪, ৩০৭,৩৮০,৩৮৭ ও ৫০৬ ধারায় স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলাটি দায়েরের তারিখ গত ২৫ মে। মামলার নম্বর ৩৬ তাং ২৫/৫/২২।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে ডাক্তার কামনাশীষ চক্রবর্তীর নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি উইম্যানভয়েসবিডিকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না। আপনাকে যে বলেছে তার কথাই লেখেন। আমি বলেই বা কী লাভ। এর আগে এক সাংবাদিককে বলেছিলাম আমার কথা লেখেনাই। না আমার কিছু বলার নাই বোন। বললেও আমার কথা লিখবেন না জানি। আসলে সেই (ভিকটিম নারী) আমাদের মারধর করেছে। ওর মানসম্মান নেই আমাদের আছে। তাই আমরা বাইরে এসব বলি না। উইম্যানভয়েস প্রতিবেদক তার মন্তব্য নিতে পরবর্তীতে যোগাযোগ করার বিষয়ে অনুমতি চাইলে তিনি সরাসরি সেটি নাকচ করে দেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী নারীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘বৈশাখী ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স মাস্টার্স করা শিক্ষিত নারী। স্বামী সংসারের জন্য ভালো বেতনের চাকরিও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বারবার নির্যাতনের শিকার হওয়া এ নারী আপোষে সংসার করতে গিয়ে আবারও নির্যাতনের শিকার। তাকে ও তার পরিবারকে উল্টো মামলায় জড়ানো হল। পুলিশ ভিকটিমকে উদ্ধার করে ঘটনাস্থল থেকে রক্তাক্ত অবস্থায়। কিন্তু মামলা নিল উল্টো ভিকটিমের বিরুদ্ধে ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বোঝা যাবে কারা মেয়েটিকে নির্যাতন চালালো যৌতুকের জন্য। ‘
বিশেষ দ্রষ্টব্য: সংবাদে আমরা স্বচ্ছতা অনুসরণ করি। মামলার নথি ও ভিকটিমের বক্তব্যের ভিত্তিতে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে বিবাদিপক্ষের সাথেও। এ সংবাদ নিয়ে বা তার কোন অংশবিশেষ নিয়ে কোন পক্ষের আপত্তি থাকলে বা নতুন করে বক্তব্য দিতে ইচ্ছুক হলে উইম্যানভয়েসবিডির ইমেইলে যোগাযোগ করুন। ইমেইল ঠিকানা:[email protected]