ভুক্তভোগী নারী আইনজীবী মনজিলা আরও বলেন, ‘আমি জেলে থাকাকালীন সময়ে আমার স্বামীকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে ও মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিতে থাকে আসামি ও তার পক্ষ অবলম্বনকারীরা। আমার স্বামীর কাছ থেকে একটি অঙ্গীকারপত্রও আদায় করেন। এরপর গত ১৬ মার্চে বিজ্ঞ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ৩ জনকে আপসের শর্তে এজাহারকারী শাহ পরান এবং আর একজন বিজ্ঞ কৌঁসুলীর জিম্মায় জামিন মঞ্জুর করেন।’
কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী চলন্ত বাসে নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলাটি দায়ের হয়েছিল ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানায় দায়ের করা ওই মামলায় আসামির সাথে আপস করার জন্য বাদির ওপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের একজন বিচারকের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে গত সোমবার (৪ এপ্রিল,২০২২) ওই বিচারকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্রার জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী নারী আইনজীবী। এ ছাড়াও আরও কয়েকজন বিচারক ফোন করে আপস মীমাংসা করতে চাপ দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১০ ধারায় দায়ের হওয়া মামলার এজাহারকারী মনজিলা সুলতানা।
রেজিস্ট্রার জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বরাবরে প্রেরিত ওই চিঠিতে ভুক্তভোগী ওই নারী আইনজীবী লিখেছেন, ‘আমি এ দেশের নাগরিক হিসেবে এবং আইনজীবী হিসেবে এবং একজন নারী হিসেবে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হব বলে সন্দেহ পোষণ করছি।’
ভুক্তভোগী নারী আইনজীবী আরও বলেন,‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারার মামলা আপস অযোগ্য। মামলাটি পরিচালনা না করতে বা মামলা তুলে নিতে আরও কয়েকজন বিচারক আমাকে মোবাইল ফোনে কল করে চাপ প্রয়োগ করেন।’ সেসব কথা রেকর্ড দলিল হিসেবে সংরক্ষণ করেছেন বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগী আইনজীবী মনজিলা সুলতানা।
তিনি বলেন, ‘একজন আইনজীবী হয়েও ন্যায়বিচার পেতে যে হয়রানি ও অবিচারের শিকার হচ্ছি তাহলে সাধারণ নারীদের কী পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে’।আপসের চাপ ও পরোক্ষ হুমকিতে আমি ও আমার পরিবার অনিরাপত্তায় রয়েছি। আমাকে যেন ন্যায়বিচার পেতে বাধাগ্রস্ত করা না হয়।’
প্রসঙ্গত: বাসে শ্লীলতাহানির শিকার হওয়া ভুক্তভোগী ওই নারী পেশায় একজন আইনজীবী। অন্যদিকে ওই মামলার আসামি শাহ পরানও আইনজীবী। এর আগে তিনি রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের আইন কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। গত ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর সহকারী জজ হিসেবে তিনি সুপারিশপ্রাপ্ত হন। এরপর ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর যমুনাটিভিসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর প্রচারের পরদিন ২ ডিসেম্বর তার নিয়োগে যোগদান স্থগিত করা হয়।
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে নারী আইনজীবীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা
ভুক্তভোগী নারী আইনজীবী বলেন,‘ফৌজদারি মামলার আসামি হয়েও সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হলে বিষয়টি নিয়ে যমুনাটিভিসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়। এতে তার নিয়োগ স্থগিত হলে ক্ষিপ্ত হয়ে অভিযুক্ত শাহ পরান আমাকে হয়রানি করতে ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের দায়ের করা মামলা আপস করতে বাধ্য করার আমার বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে।ওই মামলায় আসামি করা হয় আমার বোন, স্বামী ও বান্ধবীকে।
ভুক্তভোগী নারীর ভাষায় ‘ওই পাল্টা মামলাটি করা হয়েছে কেবল আমার দায়ের করা মামলাটি তুলে নিতে বাধ্য করার জন্য।’
মনজিলা সুলতানা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়ের হওয়ার তথ্য পেয়ে গত ১০ ফেব্রুয়ারি আমি ও অন্য তিন অভিযুক্ত মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে হাজির হয়ে আগাম জামিনের আবেদন করলে সন্তুষ্ট হয়ে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ ৪ সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করেন।’
ওই ৪ সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই গত ১০ মার্চ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে আদালত ১ জনের জামিন (আমার স্বামীর) আবেদন মঞ্জুর করে আমি, বোন ও আমার বান্ধবীসহ তিন নারীকে সি-ডব্লিউ মূলে জেল হাজতে প্রেরণের আদেশ দেন।
ভুক্তভোগী নারী আইনজীবী মনজিলা আরও বলেন, ‘আমি জেলে থাকাকালীন সময়ে আমার স্বামীকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে ও মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিতে থাকে আসামি ও তার পক্ষ অবলম্বনকারীরা। আমার স্বামীর কাছ থেকে একটি অঙ্গীকারপত্রও আদায় করেন। এরপর গত ১৬ মার্চে বিজ্ঞ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ৩ জনকে আপসের শর্তে এজাহারকারী শাহ পরান এবং আর একজন বিজ্ঞ কৌঁসুলীর জিম্মায় জামিন মঞ্জুর করেন।’
ভুক্তভোগী নারী আইনজীবী মনজিলা সুলতানা বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আমার দায়ের করা মামলাটির অভিযোগ গঠন হয়েছে, পরবর্তী তারিখ সাক্ষীর জন্য রয়েছে।আপসে এসে মামলাটিকে তুলে নেওয়ার জন্য আসামি শাহ পরান তার বিভিন্ন উপরমহলের যোগাযোগ ব্যবহার করে আমাকে হুমকি দিচ্ছে ।’
তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল মামলায় আমার জামিন হওয়ার পর ৩ এপ্রিল ছিল মামলাটির ধার্য্য তারিখ। ওই দিন আদালতে এসে জানতে পারি আপসে রাজি না হওয়ায় আসামিপক্ষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জামিন বাতিলের আবেদন করেছেন। আদালত উভয়পক্ষকে মামলা আপস করতে ৩০ মিনিট সময় বেঁধে দেন। আমি আপস করতে রাজি না হলে বিজ্ঞ আদালত উভয় পক্ষ এবং তাদের নিয়োজিত আইনজীবীদের নিয়ে বিচারকের খাসকামরায় বসেন। উভয়পক্ষের মামলা আপোষ শর্ত রেখে বিজ্ঞ আদালত জামিন শুনানির জন্য তারিখ দেন ঠিক দুদিন পর অর্থাৎ ৫ এপ্রিল।’
ভুক্তভোগী নারী আইনজীবীর ভাষায়, ‘নারী নির্যাতন মামলায় অভিযুক্ত শাহ পরান এবং বিজ্ঞ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পরস্পর পূর্বপরিচিত এবং তাদের মধ্যে সখ্যতা রয়েছে।’ বিষয়টিকে তিনি ‘সুনির্দিষ্ট পেশাগত অসদাচরণ’ উল্লেখ করে রেজিস্ট্রার জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযুক্ত শাহ পরানের বক্তব্য
অভিযুক্ত শাহ পরানের বক্তব্য তুলে ধরতে উইম্যানভয়েসবিডির প্রতিবেদক তার যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমি আপস করতে চাপ দিয়েছি এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। ডিজিটাল নিরাপত্তা মামলায় তারা জামিন পেয়েছেন আপসের ভিত্তিতে। তবুও বাদিপক্ষ আদালতকে দোষারোপ করছেন। এছাড়াও বাদিপক্ষ আমার ভিজিটিং কার্ড ও ফেসবুক আইডি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বাদিপক্ষ।
তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনারা নিউজ না করলেই ভাল হয়।’
ঘটনাটির শুরু যেভাবে
ভুক্তভোগী নারী আইনজীবী মনজিলা সুলতানা ঝুমার কথায়,‘২০২০ সালে ৪ ডিসেম্বর রাতে সেন্টমার্টিন পরিবহন নামের বাসে কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। যখন আমার একটু একটু ঘুম আসছিল তখন তার ডান হাতটা বের করে আমার বা পাশের উরুতে পাঞ্চ করেন। পরপর দুইবার করেন। আমি যখন তার দিকে তাকাতেই চাঁদর দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলেন। তখন ওনার চাঁদরটা সরিয়ে দেখি উনি ঘুমাননি। আমি তাকে স্যরি বলতে বললে আমার ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল ধরে মুচড়ে দেন তিনি। আমি ৯৯৯ এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা নিই। ওই সময়ে বাস লোহাগাড়ায় অবস্থান করছিল। প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে পুলিশ অভিযুক্ত শাহ পরানকে আটক করে ও আমি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা দায়ের করি।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় দায়ের হওয়া ওই মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন জানিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। মামলাটি এখন চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ২-এ বিচারাধীন।
ভুক্তভোগী নারীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় হাইকোর্টে আইনগত সহযোগিতা দিচ্ছেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি নিশ্চিত করেছেন, বিচারক তাঁর মক্কেলকে আপস করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছেন। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যে ধারায় তাঁর মক্কেল মামলা করেছেন, তা আপসযোগ্য নয়। (প্রথম আলো)
চিঠি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান (প্রথম আলো) বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তিনি জানাতে পারবেন। এদিকে নারী আইনজীবীর দায়ের করা মামলার আসামি শাহ পরান (প্রথম আলো)বলেন, তিনি বিচারাধীন বিষয়ে কথা বলবেন না।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: সংবাদটি প্রকাশের পূর্বে আমরা সকল দলিল পর্যবেক্ষণ করি। উভয়পক্ষর সাথে যোগাযোগ সম্পন্ন করি। এতদসত্ত্বেও কোন অংশ বা বাক্য নিয়ে কোন পক্ষের কোনরূপ আপত্তি থাকলে বা কোন তথ্য নিয়ে ভুলভ্রান্তি আছে বলে মনে করলে উইম্যানভয়েসবিডির ইমেইলে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হল।
email:[email protected]