চান্দগাঁওয়ের ছেলেসহ গুলনাহার বেগম হত্যা মামলায় ভুক্তভোগীর পরিবারকে বিনামূল্যে আইনগত সেবা দিচ্ছে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ)।
মানবাধিকার সংস্থাটির চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান উইম্যানভয়েসবিডিকে বলেছেন, ভুক্তভোগীর পরিবার আর্থিকভাবে সক্ষম না হওয়ায় আমরা তাকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আইনি সেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং আসামির সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করতে আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব।
আজ বুধবার ( ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১) মো. ফারুককে ৩০২ ধারায় অভিযুক্ত করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. সরোয়ার জাহানের আদালত প্রতিবেদনটি গ্রহণ করে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন । চান্দগাঁও থানায় দায়ের হওয়া মামলাটির নম্বর ২৯(৮) ২০২০।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর আইনজীবী বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ) চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে আবেদন করব যেন এ মামলাটিকে চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় ও দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হয়।’
কী ঘটেছিল ওই রাতে?
২০২০ সালের আগস্টের ২৪ তারিখ। চট্টগ্রাম নগরে আট বছরের ছেলেসহ নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন গুলনাহার বেগম। নিহত গুলনাহারের রান্না করা খাবার বিক্রি করতেন মামলার আসামি মো. ফারুক।
পরিচয় করে বোন পাতিয়ে গুলনাহারের বাসায় যাতায়াত করত একই এলাকার বাসিন্দা ৩১ বছর বয়সী ফারুক। ফারুককে ‘ভাই’ হিসেবে সম্বোধন করতেন গুলনাহার। গুলনাহারের হাতে তৈরি খাবার বিক্রির কাজ করত মামলার আসামি ফারুক। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে অর্থের হিসাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। এর জের ধরে ২৪ আগস্ট গুলনাহারকে হত্যা করে ফারুক। ঘটনাটি দেখে ফেলায় তার আট বছরের ছেলে রিফাতকেও হত্যা করে সে। নিহত গুলনাহারের মেয়ে গার্মেন্টসকর্মী ময়ুরী এসে দেখে মা ও ছোট ভাইয়ের রক্তাক্ত লাশ।
কীভাবে গ্রেপ্তার হয়েছিল ফারুক
২০২০ সালের ১ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) ভোরে আকবর শাহ থানার পাকা রাস্তার মাথা এলাকায় ভোরে অভিযান চালিয়ে আসামি মো. রফিককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রোল দেখে হত্যাকাণ্ডের কৌশল শিখেছে বলেও র্যাবকে জানিয়েছিল ঘাতক ফারুক। ২৪ আগস্ট রাগের মাথায় কথা কাটাকাটি নিয়ে প্রথমে তার ‘পাতানো বোন’ গুলনাহার বেগমকে খুন করে সে। মাকে খুন করার দৃশ্য দেখে ফেলায় পরে খুন করা হয় ছেলে রিফাতকেও।
১ অক্টোবর দুপুরে র্যাব-৭ চান্দগাঁও কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানিয়েছিলেন র্যাব অধিনায়ক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল।
আদালতে ফারুকের জবানবন্দি
২০২০ সালের ৪ অক্টোবর (রোববার) বিকালে চট্টগ্রামের দ্বিতীয় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে চান্দগাঁওয়ে জোড়া খুনের একমাত্র আসামি মো. ফারুক ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
ফারুক তার জবানবন্দিতে বলেছিলেন, ‘ ২০১৩ সালে দুবাই থেকে দেশে ফেরার পর গুলনাহারের স্বামীর মাধ্যমে তার সাথে পরিচয় হয়। একটি সময় গুলনাহারের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গুলনাহার তার স্বামীকে ডিভোর্স দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি না হলেও তার স্বামী তাকে ছেড়ে কুমিল্লায় চলে যান। সেই থেকে গুলনাহারের সাথে কখনও স্বামী-স্ত্রী আবার কখনো ভাই-বোনের পরিচয়ে একসাথে নগরীতে অন্তত ১৭/১৮ টি ভাড়া বাসায় ছিলেন। সর্বশেষ চান্দগাঁও আবাসিক বি-ব্লকের একটি ভাড়া বাসায় তারা থাকেন। এছাড়া ওই বাসা থেকে ১০ মিনিট দূরত্বে ফারুকের আরও একটি বাসা ছিল।’ ফারুক আবাসিকের বি-ব্লকের মুখে ভ্যানে করে বিরিয়ানি ও পান বিক্রি করতেন। গুলনাহার বিভিন্ন সময় নাশতা তৈরি করে তার মাধ্যমে বিক্রি করতেন। তবে তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি ও বিবাদ লেগেই থাকতো ‘
ফারুক বলেছিলেন, চান্দগাঁওয়ে ঝগড়া থেকে গুলনাহারের সাথে ছুরি নিয়ে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তার ছেলে রিফাতের গলায় ছুরিটি লাগে। এ সময় রিফাত মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার গলা দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে। এতে ফারুক হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তাৎক্ষণিক গুলনাহারের কাছ থেকে ছুরিটি কেড়ে নিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এলোপাতাড়ি আঘাত করে। কিছুক্ষণ পর মা ও ছেলে রক্তাক্ত অবস্থায় নিচে অচেতন হয়ে পড়ে থাকে ।‘
ফারুক জবানবন্দিতে বলেন, ‘মা ও ছেলেকে খুনের পর ঘটনাস্থলে কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন। পরে মা গুলনাহারের ওড়না ও কাপড়চোপড় দিয়ে তার শরীরের রক্তের দাগগুলো মুছেন। পরে লুঙ্গি দিয়ে শরীর ঢেকে ফারুক তার আরেকটি বাসায় গিয়ে কাপড়চোপড় পাল্টে ফেলেন। এ সময় রক্তের দাগ লেগে থাকা কাপড়গুলো একটি নালায় ফেলে দেন। ওইদিন শাহ আমানত মাজারে রাত্রিযাপন শেষে সকালে খাগড়াছড়ি উদ্দেশ্যে চলে যান। সেখানে একটি গ্যারেজে মাসখানেক কাজ করার পরে ঢাকায় চলে যান। পরে র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে।’