চোর -ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে তালা চাবি, ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশারি, মলম,ব্যাট সুরক্ষা কবচ আছে। রক্ষাকবচতো নেই ১২৫ ন্যনোমিটারের করোনাভাইরাসের, দেখাও যায় না তাকে। তার গতি প্রকৃতিও ক্ষণে ক্ষণে বদলে নিচ্ছে। যে ঘরের মানুষটাকে দেখে একদম সুস্থ লাগছে সে মানুষটাই হয়ত আপনাকে আক্রান্ত করে দেবে। কী ভয়ঙ্কর না ব্যাপারটা?
থাপ্পাড় মুভিটা নিয়ে লিখতে বসে করোনার রচনা হচ্ছে?
হ্যা। কারণ নারীদের নিয়ে সমাজের প্যারালাল অবস্থানটা করোনাভাইরাসের মত। দেখা যায় না তবে উপসর্গ অনুভব করা যায়। আমার আশেপাশের অনেককেই দেখেছি (আমিও তার মধ্যে হয়ত আমিও আছি) ভাবছে করোনা ভয়ংকর, কিন্তু আমার বা আমার প্রিয়জনের এটা হবে না। থাপ্পাড় মুভিটাও এমন। ভাল, শিক্ষিত পরিবারে মেয়েরা আর নির্যাতিত না, মার খায় না, তাদের মতামত মূল্য পায়— এমন অনেক অনেক মন্তব্য চোখে পড়লো কিছুদিনে। আসলে কী তাই? থাপ্পাড় সিনেমাটা সেরকম কিছু দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের ঠুলি পরা চোখে।
অসভ্যতা আর বর্বরতার খবর পড়তে পড়তে একসময় আমারা মেনে নিই। সমাজে এসব আছে। তবে আমি উচ্চশিক্ষিত আমার সাথে হবে না। হলেও আমি একহাত দেখে নেব। আসলে কট্টর নারীবাদিরা এসব বেশি করে বলে। মুভিগুলোও এটাই বেশি দেখায়। কিন্তু আসলেও কি তাই? অথচ এদেশে ইফতারের ঠাণ্ডা পানি না পেয়ে খুন খারাবি হয়ে যায়!
অমৃতা নামের একজন নারীর জীবন
এবার সিনেমার গল্পে আসি। গল্প আবর্তিত হয় কয়েকটি জুটির সংসার এবং প্রেম নিয়ে। অমৃতা-বিক্রমের সাজানো সংসার। শিক্ষিত অমৃতার স্বপ্ন ছিল খুব গোছানো সংসার করবে। ভালো হোমমেকার হবে। অমৃতা সব কিছু তার স্বামীর পছন্দেই করতে থাকে। সিনেমায় তার জীবনচিত্রে তাকে পারফেক্ট ওয়াইফ ও বেস্ট হোমমেকার হিসেবেই দেখা যায়। জীবনকে এভাবেই তার ভালো লাগতো।

অমৃতা নিজেকে ঠিক বুঝতে পারে নতুন কর আবিষ্কার করে যখন চড়টি তার গালে পড়ে। সে একটা সতন্ত্র ব্যক্তি নয়। যেন স্বামীর সার্বক্ষণিক এক সেক্রেটারি এবং আয়া। বিনা বেতনের এই সেক্রেটারিকে সম্মান করার প্রয়োজন মনে করে না বিক্রম। সিনেমায় আরেকটি বিষয় খুব আবছাভাবে দেখানো হয়েছে বিক্রমের বাবা তার মাকে কখনও সম্মান করেনি। সেই থাপ্পড় ঘটার পর ওলটপালট হতে থাকে অমৃতার জীবন। সমাজের ওই অদেখা রূপটি সে দেখতে থাকে প্রতিদিন নতুন করে।
বিক্রম স্যরি বলে কিন্তু সে স্যরি ছিল না কখনও। বরং তার কাছে এটি খুব স্বাভাবিক বিষয়। বিক্রমের পুরুষতান্ত্রিক মন অমৃতার সম্মানবোধকে গুরুতরভাবেই আঘাত করে। সম্পর্ক থেকে বের হতে চায় অমৃতা। ওই সিনেমায় শুধু গৃহিনীর ওপর হওয়া নির্যাতন নয়। উচ্চবিত্ত সফল নারী আইনজীবীকে খোঁটা দিয়ে আক্রান্ত করে স্বামী। সফল নারী ম্যারিটাল রেপের শিকার হয়। যাকে ভালবেসে বিয়ে করছিল তার একটা পরিবর্তে একটি ডুপ্লিকেট জীবন খোঁজে পরকীয়ায়!
মুভিটা নিয়ে বিতর্ক হল একটা থাপ্পড়ের জন্য ডিভোর্স কেন হবে?
শেষ পর্যন্ত অমৃতা ডিভোর্স নিয়েছেন। ‘হা সের্ফ থাপ্পড়, পার নেহি মার সাকতা’—এই ডায়ালগটিই এ সিনেমার মূল উপজীব্য। নির্যাতন নয়, সেটি একটি থাপ্পড় হোক। সেটি খুব প্রশংসা কুড়িয়েছে।
অন্যদিকে অনেক সমালোচক এটিকে নিন্দনীয় দৃষ্টিতে দেখেছেন। একটি চড়ে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ভাল চোখে দেখতে চায়নি আমাদের ভেতরে থাকা ডমিনেটিং পুরুষতান্ত্রিক চোখ। বেশিরভাগ সমালোচক এভাবে বলেছেন, তাহলে বুঝি সংসার ভাঙা শেখানোই তাদের উদ্দ্যেশ্য? পুরুষের মনে ডমিনেট করার ইচ্ছে সুপ্ত থাকে। নারীর মনে থাকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা। এভাবেই নির্যাতক আর নির্যাতিতের জীবন নিয়ে একটি গোছানো সংসার। সম্মান চাইলে একাই থাকতে হবে।
সংসার পুরুষের কাছে একটা সার্কাস। সে রিং মাস্টার হয়ে নারী বাঘকে বশ করতে চায়। আসলে সমাজের লুপটা ঠিক এখানে। বারবার ঘুরেফিরে এখানেই হারিয়ে যাচ্ছি আমরা।