ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার জন্য সন্তানের যত্ন নেওয়া বা ক্যারিয়ারটি খুব যথাযথ যুগোপযোগী হওয়ার জন্য যা করতে হয় বেশিরভাগ বাবা-মাই তা করেন। অথচ সন্তানকে ভালো মানুষ গড়তে যেটা করা প্রয়োজন সেটিই ঠিকভাবে করা হয় না। সন্তানকে শাসনে রাখা না বন্ধুত্ব করা কোনটি সবচেয়ে জরুরি তা নিয়েও প্যারেন্টসদের আছে মত ভিন্নতা। আমাদের সামাজিক যে চেনা দৃশ্যপট তা বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুতই। টিনেজ সন্তানের পড়াশোনা, কাজের দক্ষতা বৃদ্ধির সাথে জীবন দক্ষতা শেখানো জরুরি। সন্তানের প্যারেন্টিং কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে চট্টগ্রামের টিনেজ সন্তানের প্যারেন্টস এমন নারীরা এসব মন্তব্য করেছেন। বেশিরভাগ নারীরাই বলেছেন, জীবন দক্ষতায় অন্যের প্রতি আচরণ ও যৌন শিক্ষাকে অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন। ক্যারিয়ারের বাইরেও বিশাল একটি জীবন। অপরাধ থেকে মুক্ত থেকে একটি সুস্থ পরিবেশ তৈরিতে প্যারেন্টদের যে কাজ সেটি সামাজিক করে তোলা প্রয়োজন।
প্যারেন্টরা বলছেন,সময়ের সাথে আমরা নৈতিকতাসহ অনেককিছু পরিবর্তন হতে দেখছি। যদিও আমরা নিজেদের কৈশোরে এমন জীবনাচরণে অভ্যস্ত ছিলাম না। তবুও মানতে হবে আমরা সবাই এ পরিবর্তনের অংশ। আমরা সবাই দাবি করি আমরা সন্তানের বন্ধু। কিন্তু আসলে কী তাই? সময়ের সাথে সাথে যে অসহনশীলতা ও অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে এতে কিছুটা হলেও প্যারেন্টিং বা পরিবারের শিক্ষার ভূমিকা থাকে। টিনেজে এসে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সাথে আচরণ ও জেন্ডার শিক্ষায় বাবার ভূমিকা খুব কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারে। কয়েকজন নারী মত দিয়েছেন বাবাদেরও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ প্রয়োজন এজন্য প্যারেন্টদের স্কুলিং বা ট্রেনিং প্রোগ্রামে গুরুত্ব দিতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইংলিশমিডিয়াম স্কুল পড়ুয়া কিশোর ছেলেমেয়ের মা বলেছেন, আমি আমার ছেলে ও মেয়েকে একই শিক্ষা ও একই সুযোগ দিচ্ছি। একইরকম স্বাধীনতাও। আমার মেয়েটিও গ্রুপ স্টাডি করতে যায় বা কখনও ওর বন্ধুরা এখানে আসে। যে বিষয়টি আমি অ্যালাউ করি না তা ছেলের জন্যও করি না। চাকরি ছেড়ে দিয়ে সন্তানদের উপর চোখ রেখেছি। তাদের শাসন করতে নয় সময় দিতে। তাদের সাথে বসে সিনেমা দেখি, ঘুরতে যাই। কিন্তু দুশ্চন্তাতো যায় না। অন্য একজনের সন্তান তো এমন আচরণ করা শিখছে না। তারা হয়তো শিখছে, ‘মেয়ে হলে অন্যরকম হতে হবে।’ যৌক্তিক শিক্ষা ও দক্ষতা শুধু পরিবার থেকে সম্ভব নয়। প্যারেন্টিংয়ে রাষ্ট্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্যারেন্ট স্কুলিংয়ের কথা আমি এখনই বলব না। কারণ অনেক বাবা মা টিচার্স মিটিংয়ে আসতেও সময় পান না। তারা স্কুলিংয়ে থেকে সন্তান লালন শিখবেন সে কথা বলা যায় না।
শাহনাজ পারভীন নামের এক প্যারেন্ট বলেছেন, আমি দুটি সন্তানের মা, দুটোই মেয়ে। বুঝতেই পারছেন মেয়ের মা বলে পথটা বেশি কঠিন। এ নিয়ে আফসোস নেই কারণ আমার কাছে ছেলে-মেয়ে দুটোই সমান। আমার বড় মেয়ের বয়স ১৮, ছোটজনের ৯। মেয়েদের সাথে বন্ধু হয়ে তাদের মনের কথা জানি ও উতসাহ দেই। আমি মনে করি প্যারেন্টসদের স্কুলিং প্রয়োজন কারণ ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে,হাত ধরে সবাইকে নিয়ে যেতে হবে তার বাইরে অনেকেই কিছু করেন না।
এ বিষয়ে দৈনিক আজাদীর (চট্টগ্রামের দৈনিক) প্রধান প্রতিবেদক হাসান আকবর বলেছেন, ‘আমরা যেভাবে শাসনে বড় হয়েছি। এ জেনারেশনটা ঠিক তেমন নয়। তাদের সবই যে খারাপ তাও বলছি না। অনেক ক্ষেত্রেই এই জেনারেশনটা যে কী হয়ে যাচ্ছে সেটা আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সবার কথা নয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে নৈতিক স্থলন ও অসামাজিক আচরণ, এমনকী অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে শিশু কিশোররা।’
প্যারেন্টিং-এ বাবার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণও প্রয়োজনীয় কী না এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসান আকবর বলেন,‘প্রযুক্তি ব্যবহারে সন্তানদের দিকে আরও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বন্ধুত্ব ও শাসন দুটির সংমিশ্রণ থাকতে হবে। কারণ খারাপ যা কিছু হচ্ছে তা নিয়ে প্যারেন্টেসদের কিছুটা দায় অবশ্যই আছে। বাবাদের ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব মায়েদের হাতে ছেড়ে দেওয়াও ঠিক নয়। এখনের যে পরিবর্তিত সময় বাবা মা দুজনেই চাকরি করেন, এক্ষেত্রে বাবা মায়ের দুজনেরই সমান ভূমিকা থাকা উচিত।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংযোগ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সাদিয়া নাসরিন বলেন,আমার কাছে প্যারেন্টিং কোন আলাদা টাস্ক নয় আমার জীবনযাপনই সন্তানদের জন্য প্যারেন্টিং। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় আমরা সন্তানকে বলি একরকম অন্যদিকে তাদের সামনেই আমরা অন্যরকম জীবনযাপন করি। এ কারণেই ওরা সঠিক শিক্ষাটা পায় না।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা প্যারেন্টিং শুরু করি মিথ্যে দিয়ে। যেমন তাদের জন্ম কীভাবে ওই প্রক্রিয়াটি না জানিয়ে আমরা বলি ‘তোমাকে কুড়িয়ে পেয়েছি’, ‘তোমাকে পরী এসে দিয়ে গেছে’ । এমন তো না যে তারা পরে জন্মের প্রক্রিয়াটি জানে না। শিশুকাল পেরুতে পেরুতে বা তার আগেই মানুষের জন্মের প্রক্রিয়াটি তারা জেনে যায় এবং তারা ভুলভাবে জানে ও ভুলভাবে শেখে। ওরা শিখে পর্ন দেখে বা সোসাইটাল লার্নিংয়ের মাধ্যমে। সেখানেই প্যারেন্টিংয়ের ঘাটতিটা তৈরি হয়।
প্যারেন্টদের স্কুলিং প্রসংগে জানতে চাইলে সাদিয়া নাসরিন বলেন, প্যারেন্টদের ট্রেনিং প্রোগ্রাম, অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম হতে পারে। সেটি ইতিবাচক হবে। বিশেষত জেন্ডার এডুকেশনটা কীভাবে দেওয়া উচিত সে বিষয়ে প্যারেন্টদের শর্ট কোর্স বা ট্রেনিংয়ের আওতায় আনা যায়। তবে পুরোপুরি স্কুলিং প্রক্রিয়া নিয়ে বলতে গেলে সেটি বর্তমান বাস্তবতায় এখনই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী শামীমা ফেরদৌস মিলি বলেছেন, প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে জীবন চলার জন্য নীতিমালা দরকার,সেটা হোক সামাজিক বা ধর্মীয়। প্রত্যেক ধর্মে কিন্তু মানুষকে অনৈতিক কাজ হতে বিরত থাকতে বলে। পাপ কিংবা পূণ্য কি সেটা শেখায়। মানুষের জীবনে পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষা খুব জরুরি। অনেকেই বলে আমরা বাবা-মারা সময় দিচছি না।আসলে সময়ে সাথে মাবাবা দুজনেই জীবিকার জন্য কাজ করছে।কিন্তু কাজের সাথে সাথে মাবাবাকে সন্তানদের কোয়ালিটি সময় দিতে হবে।রাষ্ট্রকেও দায়িত্ব নিতে হবে সমান ভাবে।নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য ড্রাগ অনেকাংশেই দায়ী।প্রশাসনকে দূর্নীতিমুক্ত হতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আরেকটা বিষয় হল টিচার আর গার্ডিয়ানদের সাথে কমিউনিকেশন গ্যাপ অনেক। সেটা কমাতে হবে।ভালো রেজাল্টের জন্য দাড়ি,কমা, সেমিকলনের ভুল না ধরে সন্তানের আচরণের ভুলগুলো সংশোধন করতে হবে। তাদের ব্যাস্ত রাখতে হবে ক্রিয়েটিভ কর্মকাণ্ডে। শিশুদের নৈতিকতা বোধ জাগাতে অবশ্যই প্যারেন্টদের স্কুলিং জরুরি। তবে আমি বলব এক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষা শিশুদের মৌলিক সত্ত্বা ও চরিত্র গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ও করবে। ধর্মীয় শিক্ষা তাদের আদব-কায়দা শেখায়।’
তিনি আরও বলেন, শিশুদের বাবা-মাদের পদ্ধতিগত সামাজিকিকরণ শিক্ষার দরকার আছে অবশ্যই। শিশুদের নৈতিকতার বিকাশ না হলে শিশু তার গোটা শিক্ষা জীবনের বিকাশ থেকে পিছিয়ে যায়। নৈতিকতা মূল্যবোধ জাগ্রত হওয়া একটা বড় ধরণের স্কিল শিশুদের জন্য।’
চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটায় সেন্ট স্কলাস্টিকা গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষক মার্গারেট সাহা বলেন, আজকাল অনেককিছুআ ঘটছে যা ভয়াবহ। এজন্য ভুল প্যারেন্টিংও অনেকখানি দায়ী। সন্তানদের প্রকৃতভাবে ব্যাক্তিত্ব গঠনের জন্য বাবামাকেই এগিয়ে আসতে হবে কারণ প্রথম শিক্ষা সন্তানরা পরিবার থেকে পেয়ে থাকে। এজন্যই সন্তানকে জন্ম দেওয়ার আগেই বাবামা প্যারেন্টিং বিষয়ে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। এজন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে। তা না হলে সন্তানকে সঠিকভাবে ও সঠিক পথে নির্দেশনা দেওয়া অসম্ভব।