১৯২০ সালের ১৭ মার্চ । ফরিদপুর জেলারগোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার শেখ লুৎফর রহমানের টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। ঘটনা তেমন কিছু না। লুৎফর রহমান সাহেবের স্ত্রী সায়েরা খাতুন আজ সকালে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছেন। লুৎফর রহমানের প্রথম পুত্র সন্তান। স্বভাবতই তাকে নিয়ে একটু বেশি মাতামাতি। তার আরো দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তাদের জন্মতেও তিনি সমান খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু এবার মনে হয় পুরো গ্রামের মানুষ ভেঙে পড়েছে তার বাড়িতে ফুটফুটে সন্তানটিকে এক নজর দেখতে। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম রাখলেন ‘শেখ মুজিবুর রহমান।’ আর আদর করে সবাই ডাকত ‘খোকা’।
১৯২৭ সাল শেখ মুজিবুরের বয়স ৭। ভীষণ দূরন্ত আর ডানপিটে। মুজিবুররা ৬ ভাইবোন। বড় বোন ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়াা বেগম, সেজ বোন হেলেন, ছোট বোন লাইলী আর ছোট ভাই শেখ আবু নাসের। ৬ সন্তান আর এতো বড়ো সংসার সামলাতে মা সায়রা বেগমের হিমশিম অবস্থা। এই ফাঁকে পুরো গ্রাম চষে বেড়ায় মুজিবুর। কপালে বেশিদিন সুখ সইলো না। বাবা ভর্তি করে দিলেন গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলে কিন্তু খুব মনোযোগী ছাত্র মুজিবুর।
১৯২৯ সাল। মুজিবুর এখন ৯ বছরের কিশোর। গিমাডাঙা ছেড়ে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হলো। কিন্তু হঠাৎ করেই চোখে কি একটা সমস্যা হলো। ডাক্তার জানালেন সার্জারি করা ছাড়া উপায় নেই। সার্জারি হলো। অনেক সময় লাগলো সেরে উঠতে। মাঝখান থেকে ৪ বছর স্কুলে যেতে পারলো না মুজিবুর। কিন্তু সহজে দমবার পাত্র নয় সে। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হলো। এখান থেকেই তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন মুজিবুর।
১৯৩৮ সালে স্কুল পড়ুয়া পুত্রের বিয়ে দিয়ে দিলেন বাবা লুৎফর রহমান। কণের নাম ফজিলাতুন্নেসা। এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে একটু অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হলেও সে সময়ে ১৮ বছর বয়েসী বালকদের পূর্ণাঙ্গ পুরুষ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো।
১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে এক কান্ড ঘটালো মুজিবুর। সে বছর স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই দুই বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে হাজির হতে যেখানে স্কুলের সবার কলজে শুকিয়ে কাঠ। সেখানে মুজিবুর স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবি নিয়ে একটি দল গঠন করে তাদের কাছে যান। বলা চলে সাধারণ মানুষের দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সেই থেকে তার নেতৃত্ব দান শুরু। সেদিন থেকে সকলের মুজিবুর একটু একটু করে হয়ে উঠতে থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেরে বাংলা ফজলুল হক অভিভুত হলেন কিশোর খোকার সাহসিকতা দেখে। সে থেকে শুরু হয় রাজনৈতিক পথ চলা। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। সে সাথে এক বছর মেয়াদে কাউন্সিলর হিসাবে নিরর্বাচিত হন।
টুঙ্গিপাড়ার ডানপিঠে উদ্যমী খোকা সারা বাংলার মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রতি মুহুর্তে ধারণ করেছে নিজের সেই শৈশব কৈশোরের দিন গুলি। তাই একবার নিজ এলাকার কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু একটি অনুরোধ করেছিলেন। অনুরোধটি ছিল এমন- ‘আমি মরে গেলে তোরা আমাকে টুঙ্গিপাড়ায় কবর দিবি। আমার কবরের ওপর একটি টিনের চোঙা লাগিয়ে দিবি।’ একজন তাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘টুঙ্গিপাড়ায় আপনার কবরের কথাটি না হয় বুঝলাম, টুঙ্গিপাড়া আপনার জন্মস্থান। কিন্তু এই চোঙা লাগানোর ব্যাপারটি তো বুঝলাম না।’ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ায় শুয়ে আমি পাখির ডাক শুনব, ধানের সোঁদা গন্ধ পাব। আর চোঙা লাগাতে বলছি এজন্য যে, এই চোঙা ফুঁকে একদিন শেখ মুজিব নামের এক কিশোর ‘বাঙালি’ ‘বাঙালি’ বলতে বলতে রাজনীতি শুরু করেছিল।’
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের এ দেশ প্রেমের দাম দিতে হয়েছে নিজের জীবন দিয়ে। অভাগা এ জাতি হিসাবে তার জন্মদিনে কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি-
তোমার মৃত্যু হয়নি
তুমি আছো ;
তুমি স্মরণীয় চিরকাল।
শুধু ওরা নিঃশেষে হয়েছে
ইতিহাসের কীট
ঘৃণার অতলে ওরা চিরকাল
বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর – মোশতাক।
লেখক – কলামিস্ট