ড. সালেহা কাদের। মিরপুরের প্রথম ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, ‘চেরী ব্লোজমস ইন্টান্যাশনাল স্কুল’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ও চেয়ারম্যান। শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এই সংগ্রামী নারীর জীবনসংগ্রামের আদ্যোপান্ত
মিরপুরের এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে আমার জন্ম। বাবা ছিলেন বিটিএমসির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার বড়। সত্তরের দশকের শেষভাগে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে নারীদের অধিক পড়াশোনাকে মোটেই উৎসাহিত করা হতো না। আমার পরিবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। স্কুলে পড়াকালীনই তাই বিয়েতে সম্মত হতে হয়। স্বামীর সঙ্গে আমার বয়সের ব্যবধান ছিল বেশ। এরই মধ্যে এক কন্যাসন্তানের জননী হলেও নিজের অদম্য প্রচেষ্টায় বদরুন্নেসা কলেজ থেকে পাস করে মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ ও ঢাকা ডেন্টালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু পরিবার থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াটাকে অনুৎসাহিত করা হয়। শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে পুত্রসন্তানের জননী হই। প্রাণিবিজ্ঞানের পাশাপাশি এডুকেশনেও মাস্টার্স করেছি। মাস্টার্স শেষে কম্পিউটার প্রগ্রামিং শিখি। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ-অবধি প্রথম স্থান ছিল আমার দখলে। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া গয়না বিক্রি করে এক লাখ টাকা দিয়ে কম্পিউটার কিনি। এ কারণে সে সময় বাসায় বেশ বকুনিও খেতে হয়েছিল। দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা বাসায় এসে কম্পিউটার ও স্পোকেন ইংলিশ শিখত। এর মধ্যেই ১১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অ্যাডমিন ক্যাডারে যোগদানের সুযোগ পাই। কিন্তু বদলির চাকরির কারণে পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে ভেবে সরকারি চাকরিতে না গিয়ে একটি প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি সংস্থায় অপেক্ষাকৃত উচ্চ বেতনে যোগ দিই।
১৯৯১-৯৫ সাল পর্যন্ত সংস্থাটিতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করেছি। এখানে কম্পিউটার প্রগ্রামিংয়ে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছি। এ সময় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি। মিরপুরে কিন্ডারগার্টেন স্কুল থাকলেও তখনো কোনো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গড়ে ওঠেনি। ১৯৯৬ সালে শুরু হয় স্কুলের কার্যক্রম। মূলত এর সূচনা তারও এক-দেড় বছর আগে। সে সময় অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় ও ছুটির দিনগুলোতে প্রতিবেশী ও পরিচিতজনদের সঙ্গে স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পরামর্শ নিতাম। বাবা তখন চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ায় সংসারের খরচ চালাতে তাঁর ওপর কোনো অতিরিক্ত চাপ পড়ুক—এটা আমি কোনোভাবেই চাইনি। যে কারণে নিচতলা থেকে তিনি যে ভাড়া পেতেন সেই ভাড়াতেই তাঁর কাছ থেকে স্কুলের জন্য ভাড়া নিয়েছিলাম। সাড়ে সাত কাঠার ওপরে নির্মিত আমাদের এই দ্বিতল বাড়িটি। আমার স্বামীও তত দিনে অবসরে। কম্পিউটার ও স্পোকেন ইংলিশ শেখানো হতে সঞ্চিত অর্থ ও চাকরির মাধ্যমে অর্জিত পুঁজি দিয়েই স্কুলের শুরু। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের আসা-যাওয়ার জন্য একটা বাস কিনতে গিয়ে ছোট বোনের কাছ থেকে ব্যক্তিগত ঋণ করতে হয়েছে। শুরুর বছর ছাত্র-ছাত্রী ছিল ৬০ জন। ছয় মাসের মধ্যেই ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা হয় ১০০। শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ১০-১২ জন। পল্লবীর বিভিন্ন বাসায় গিয়ে আমি নিজেই স্কুলের প্রচার করেছি। শুরুতে প্লে গ্রুপ থেকে স্ট্যান্ডার্ড ফাইভ পর্যন্ত ছিল স্কুলের কার্যক্রম।
ছাত্র-ছাত্রী বেড়ে যাওয়ায় ১৯৯৯ সালে স্কুল স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পৈতৃক ভিটার কাছেই মিরপুর ১০ নম্বর বেনারসি পল্লীতে অবস্থিত ছয় কাঠার ওপর নির্মিত একটি বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলা ভাড়া নিই। দুটি ফ্লোরের মাসিক ভাড়া ছিল ৪০ হাজার টাকা। অ্যাডভান্স ছিল চার লাখ টাকা। এত ব্যাপক টাকার সংকুলান করতে না পেরে লন্ডনপ্রবাসী আমার ছোট বোনের কাছ থেকে কিছু ঋণ নিই। সে সময় শিক্ষকদের বেতন ছিল সর্বনিম্ন তিন হাজার এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। স্কুলের মাসিক ব্যয় ছিল প্রায় এক লাখ টাকা। আয়ও ছিল কাছাকাছি। স্কুল সময়ের বাইরে ছাত্র-ছাত্রীদের ফক্সপ্রো প্রগ্রামিং ও স্পোকেন ইংলিশ শিখিয়ে বাড়তি আয়ের জন্য ধীরে ধীরে স্কুলের জন্য তিনটি কম্পিউটার কিনি। সেই আয়ও স্কুলে বিনিয়োগ করেছি। স্কুল থেকে লভ্যাংশ কখনো নেওয়ার চিন্তা করিনি। এরই মধ্যে শিক্ষকসংখ্যা বেড়ে হলো ১৮-২০ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে এই স্কুলেই যোগদান করে একমাত্র মেয়ে। ছাত্র-ছাত্রী তখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ জন। ২০০৩ সালে ইউকে থেকে প্রথম ‘ও’ লেভেল পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির অনুমতি পাই।
এ সময় বাড়িভাড়া উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকঋণ নিয়ে স্কুলের জন্য একটি স্বতন্ত্র ভবনের চিন্তা মাথায় আসে। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে সাত কাঠা জমির ওপর নির্মিত একটি সাড়ে চারতলা বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেল। সুদের হার ও সময় বাড়িয়ে ডাউনপেমেন্ট কমিয়ে প্রথম ইনস্টলমেন্ট ২২ লাখ টাকা নির্ধারণ করে একটা লিজিং কম্পানির কাছ থেকে ঋণের ব্যবস্থা হলো। লিজিং কম্পানির সেই ঋণ এখনো পরিশোধ করে চলেছি। এরই মধ্যে পাঁচতলার কাজ শেষ করেছি। নিচ থেকে চারতলা পর্যন্ত স্কুল। পাঁচ তলায় আমরা থাকি। ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলে চেরি ব্লোজমস-এর ছাত্র-ছাত্রীরা বেশ সফলতা অর্জন করছে। নিয়মিত অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছে। বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছি অভিভাবকদের তরফ থেকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের জুলাই মাসে একমাত্র ছেলে মোজাক্কির হোসেন খান মিশু মারা যায়। সে ছিল নৌ-বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার ও একজন অভিজ্ঞ হেলিকপ্টার প্রশিক্ষক। মেয়ে প্রমোশন পেয়ে বর্তমানে স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে আমাকে সহযোগিতা করছে। ছেলের মৃত্যু শোক কাটিয়ে ওঠার জন্য পড়াশোনা ও কাজের মধ্যে অধিকতর ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করছি। স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছি। এ ছাড়া অনগ্রসর শিশুদের জন্য শিক্ষাবৃত্তিসহ সামাজিক ও মানবিক কাজ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ওয়ার্ল্ড এডুকেশন কংগ্রেস গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড, মাদার তেরেসা অ্যাওয়ার্ডসহ আরো বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছি। ইত্যবসরে ‘চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড প্রসপেক্টস অব ইংলিশ মিডিয়াম এডুকেশন ইন বাংলাদেশ’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছি। পড়াশোনাসহ যেকোনো কাজের ব্যাপারে আমার অবিচল আস্থা ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞাই আমাকে আজকের অবস্থানে আসতে সহযোগিতা করেছে।