কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমরা ভাবতাম, ত্বকের ছত্রাক সংক্রমণ গ্রীষ্মকালে ও বর্ষাকালে বেশি হয়, নিজে থেকেই অধিকাংশ ত্বকের ছত্রাক সংক্রমণ সেরে যাবে। ওষুধ দেওয়ার একেবারে দরকার হবে না তা নয়, কিন্তু আমাদের ধারণা ছিল ছত্রাক সংক্রমণ সারানো আদৌ কঠিন নয়। মুশকিল হল এখন আর এভাবে নিশ্চিন্ত থাকা যাচ্ছে না। কারণ যতদিন যাচ্ছে, আমরা দেখছি সারা বছর ধরেই ত্বকের এক ধরনের ছত্রাক সংক্রমণের প্রকোপ থেকেই যাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, ছত্রাক সংক্রমণ আগের চাইতে অনেক বেশি ওষুধ-প্রতিরোধী (রেজিস্ট্যান্ট) হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রচলিত ওষুধে আর কাজ হচ্ছে না।
গত ৩০ বছরে বেশ কিছু ছত্রাক সংক্রমণ সারানোর নতুন ওষুধ বাজারে এসেছে। গত ১০ বছরে আমরা দেখেছি, পুরনো ওষুধগুলো অকেজো হয়ে যাচ্ছে এবং নতুন ওষুধের কার্যকারিতা আগের মতো নেই। আগে ছত্রাক সংক্রমণে যে ওষুধগুলো দিলে কাজ হতো, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি দামি ওষুধ ও নতুন ওষুধ দিতে হচ্ছে। অনেক সময় তাতেও কাজ হচ্ছে না। তখন ডাক্তার এবং রোগী উভয়েই সমানভাবে অসহায় বোধ করছেন।
অনেক সময় ত্বকের বেশ গভীরে ছত্রাক সংক্রমণ হতে পারে, খুব বিরল ক্ষেত্রে ছত্রাক সংক্রমণ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হওয়া অসম্ভব নয়— কিন্তু সেগুলি বিরল রোগ। খুব পরিচিত কয়েকটি সংক্রমণের কথা বলি।
হাজা
ডাক্তারি ভাষায় ক্যান্ডিডা সংক্রমণ। যারা একটু বেশি পানি ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাদের হাত বা পায়ের আঙুলের ফাঁকে হাজা হয়। বর্ষাকালে বেশি হয়। কথ্য আছে, ‘হাজার চিকিৎসা করেও হাজা সারে না।’ কিন্তু না, বহুদিনের পুরনো ওষুধ ক্লোট্রিমাজল বা মাইকোনাজোল ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে লাগালে এখনও তা কাজ করে। হাত পা শুকনো রাখলে, উপযুক্ত মলম লাগালে ও খাবার ওষুধ খেলে হাজা সেরে যায়। তবে ক্যানডিডা সংক্রমণ থেকে অনেক সময় পুরুষ ও মহিলাদের জেনাইটালে চুলকানি, লাল হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হয়। তার পেছনে অনেক সময় নানা রোগ লুকিয়ে থাকে, যেমন ডায়াবেটিস। সেই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা আবশ্যক, নইলে এ-রোগ আর সারবে না।
ছুলি
এই অসুখের বৈজ্ঞানিক নাম পিটিরিয়াসিস ভারসিকালার। এই রোগটি অতিপরিচিত। গ্রীষ্মকালে আর বর্ষাকালে অনেকের ত্বকে এই রোগ ফিরে ফিরে আসে। সাদা সাদা ছোপ পড়ে যায়, অনেক সময় ছোপের রং একটু কালচে হতে পারে। এই অসুখও আমাদের মাথাব্যথার কারণ নয়। তাই বলে রোগটি একবারে সারিয়ে ফেলা সোজা নয়। ছুলি হওয়ার প্রবণতা থাকলে, শরীরের ফাঙ্গাসগুলো পুরো মেরে ফেলার পরেও রোগীর পুনরায় সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে আবার পরের বছর গায়ে ফের ছুলি দেখা যায়। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় এখনও পর্যন্ত এই অসুখ ওষুধ প্রতিরোধী হয়নি। ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে ক্লোট্রিমাজল, মাইকোনাজল ইত্যাদি নানারকম মলম লাগালে, এবং কিছু ছত্রাক মারার ওষুধ খেলে, সেটা অন্তত মোটামোটিভাবে চলে যায়। কখনও কখনও ছত্রাকনাশক শ্যাম্পু গায়ে মাখা হয়, তাতেও ভালো কাজ দেয়।
খুশকি
মাথার খুশকি সবসময় ছত্রাকের জন্য হয় না। এমনকী মাথায় ছত্রাক থাকলেও সেটা খুশকির জন্য পুরোপুরি দায়ী না হতে পারে। কিন্তু আমাদের এটুকু জানা দরকার যে অধিকাংশ ধরনের মাথার খুশকিতে ছত্রাকনাশক শ্যাম্পু এবং ছত্রাকনাশক লোশন যথেষ্ট কার্যকর। কার্যকর মানে কিন্তু এই নয় যে একবার ঠিকমতো চিকিৎসা করলে খুশকি চিরকালের মতো সেরে যাবে। তা যাবে না, আবার হয়তো ফিরে আসবে। পুনরায় শ্যাম্পু লাগালে আবার তখনকার মতো খুশকি চলে যাবে।
দুরারোগ্য ছত্রাক সংক্রমণ
দাদ
ইংরেজিতে বলে রিং ওয়ার্ম। খুবই পরিচিত অসুখ। বিশেষ করে কুঁচকিতে জীবনে অন্তত একবার দাদ হয়নি এমন পুরুষের দেখা পাওয়া ভার। গ্রীষ্মকাল ও বর্ষা, উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াতে দাদের সমস্যা বেশি হয়। বিশেষ করে শরীরের ভাঁজের দিকে, যেমন কুঁচকি, বগল, নিতম্বের খাঁজে, মহিলাদের ব্রেস্টের তলায় সংক্রমণ বেশি হতে দেখা যায়। রোগটি রোগীদের খুব পরিচিত। অনেক রোগী আমাদের কাছে এসে নিজেরাই বলেন যে তাদের দাদ হয়েছে। গোল গোল, চাকা চাকা দাগ দিয়ে শুরু হয়, চুলকায়, ও কিছুদিন পরে গোল চাকাগুলো বাইরের দিকে ছড়াতে থাকে এবং মাঝখানটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার হয়ে যায়। এইভাবে আংটির মতো আকৃতি হয়ে যায় বলে একে রিং ওয়ার্ম বলে। আরও দিন গেলে এই আংটির মত ব্যাপারগুলি একে অন্যের সঙ্গে মিশে যায়, এবং শরীরের একটা বড় অংশ রিংওয়ার্ম দিয়ে ঢেকে যায়। রোগীর প্রচণ্ড কষ্ট হয়, চুলকায়। চুলকানির চোটে রাতে ঘুম হয় না। এই দাদের ফাঙ্গাস, ডাক্তারি পরিভাষায় যাদের বলে ডার্মাটোফাইট ছত্রাক, নখে আক্রমণ করে অন্যরকম রোগ সৃষ্টি করতে পারে আমরা যাকে বলি ওনাইকোমাইকোসিস। এই রোগ সারানো চিরকালই কঠিন ছিল, এখন কঠিনতর হয়েছে। আবার রিং ওয়ার্ম চুল বা দাড়িগোঁফ-এর গোড়ায় আক্রমণ করে অন্য রকম রোগ সৃষ্টি করতে পারে। চুল দাড়ি গোঁফ-এর গোড়ায় বা নখে যখন এরা আক্রমণ করে তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া রোগ নির্ণয় করা মুশকিল। নখে আক্রমণ করলে সাধারণত নখটি মোটা, অমসৃণ ও কালচে রঙের হয়ে যায়। চুলের গোড়ায়, দাড়ি-গোঁফের গোড়ায় সংক্রমণ হয়ে অনেক সময় ছোট ছোট ফোঁড়ার মতো হয়।
এবার আসি এই ডার্মাটোফাইট বা দাদ জাতীয় ফাংগাস আক্রমণের চিকিৎসায়। থেকে ২০ বছর আগে গ্রিসিওফুলভিন মুখে খাওয়ালে এবং মাইকোনাজল বা ক্লোট্রিমাজল ওষুধ লাগালে রোগী ৪-৮ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যেতো। এই ওষুধগুলো সস্তা ছিল, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অল্প-স্বল্প ছিল, কিন্তু তত বেশি মাথা ঘামাতে হতো না। এখন ত্বকরোগ-বিশেষজ্ঞদের প্রায় সকলেরই একটাই অভিমত যে, আগের ওষুধগুলো কাজ করছে না। তার বদলে নতুন ওষুধ, যেমন আক্রান্ত স্থানে ব্যবহারের জন্য লুলিকোনাজোল ইত্যাদি, খাবার জন্য টারবিনাফিন ও ‘ইট্রাকোনাজল’ এগুলো ব্যবহার করতে হচ্ছে। এগুলো যথেষ্ট দামি এবং এগুলি দেওয়ার জন্য রোগীর কিছু রক্ত পরীক্ষা করতে হয়, তারও খরচ আছে। শুধু তাই নয়, চিকিৎসার সময়কাল বেড়ে যাচ্ছে। আগে ৪-৮ সপ্তাহ চিকিৎসা করাতে হতো, এখন ১-৩ মাস পর্যন্ত চিকিৎসা করাতে হচ্ছে। আশঙ্কার বিষয় তার পরেও কোনও কোনও রোগী পুরো ভালো হচ্ছে না।
এই রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এমন সমস্যা কিভাবে উদ্ভব হলো সেটা এখনো পর্যন্ত খুব ভালোভাবে জানা যায়নি। কিন্তু মোটের ওপর যে কথা জানা গিয়েছে তাতে বলা যায় যে, ছত্রাক আক্রান্ত ত্বকে স্টেরয়েডজাতীয় মলম লাগানোর কারণে এই ছত্রাক ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে যায়। আর একটা কারণ হলো অনিয়মিত চিকিৎসা। অর্থাৎ কয়েকদিন চিকিৎসা করিয়ে বন্ধ করিয়ে দেওয়ার পরে ফের চালু করা। অন্য আরও কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন, আর নতুন ওষুধ বের করার প্রচেষ্টা সবসময়ই চলছে।
রোগগুলো প্রতিরোধের মূল উপায় হল সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
মনে রাখুন
আঁটসাঁট ও সিন্থেটিক অন্তর্বাস পরবেন না।
গ্রীষ্ম বর্ষাতে যতটা সম্ভব হালকা সুতির পোশাক পরুন।
শরীরের ভাঁজ এর জায়গাগুলোতে ঘাম জমে থাকা এড়িয়ে চলুন।
একটানা দমবন্ধ ভ্যাপসা পরিবেশে কাজ করবেন না।
পরিবারের অন্য সদস্যের জামাকাপড় পরবেন না। নিজের পোশক অন্য কাউকে দিবেন না।
প্রত্যেকের গামছা তোয়ালে আলাদা রাখুন।
কারোর সংক্রমণ হয়ে গেলে একই বালতিতে বা ওয়াশিং মেশিনে তার জামাকাপড়ের সঙ্গে অন্য জামাকাপড় ভেজাবেন না।
জামা কাপড় কাচার পরে সেগুলো খুব ভালো করে শুকনো করুন।
জিন্স জাতীয় মোটা পোশাক ভালোভাবে ইস্ত্রি করুন।
অন্তর্বাস সূর্যালোকে খড়খড়ে করে শুকনো করুন।
এরপরেও যদি ছত্রাক সংক্রমণ হয়ে যায়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ওষুধের কোর্স শেষ করুন। ওষুধ বিষয়ে এবং সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে চিকিৎসকের উপদেশ পুরোটা শুনুন এবং তা মেনে চলুন। রোগ লক্ষণ কমে গেলে নিজের ইচ্ছামত ওষুধ বন্ধ করবেন না। ওষুধের ব্যাপারে অনিয়মিত হবেন না।
কখনোই ডাক্তার ব্যতীত আর কারো পরামর্শ অনুসারে চুলকানি কমানোর মলম লাগাবেন না। বাজারে দাদের মলম নাম দিয়ে যেসব ওষুধ বিক্রি হয় তার মধ্যে অনেকগুলোই ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। ওষুধের দোকানদার ডাক্তার নন, তিনি অনেক সময়ই চটজলদি চুলকানি কমানোর জন্য স্টেরয়েড মিশ্রিত পাঁচমেশালি মলম দেন। তাতে চুলকানি কমে যায়, কিন্তু ওই রোগ আরও ছড়িয়ে পড়ে, পরে তা সারানো দুঃসাধ্য হয়ে যায়। সাবধানে থাকুন, গরমে বা শীতে, বর্ষা বা হেমন্তে, ছত্রাক সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচুন।