২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে চবি ক্যম্পাসের নিজের বাসা উদ্ধার করা হয়েছিল ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের ঝুলন্ত লাশ। প্রথম ফরেনসিক রিপোর্টে এ মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করা হলেও দ্বিতীয় রিপোর্টে আঘাত ও জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়। ওই হত্যাকাণ্ডের চার বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও তদন্তেই আটকে আছে মামলার ভাগ্য। হত্যার পর চার বছর ধরে দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে। হত্যা মামলার এজাহারে নাম থাকা আসামিদের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলেও রহস্যময় কারণে গ্রেপ্তার হয় না তারা। দিয়াজের পরিবার বলছে— রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই গ্রেপ্তার হচ্ছে না।
উইম্যানভয়েসবিডিকে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার সন্তানকে খুন করা হয়েছে। আর খুনিরা বাইরে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে চেয়ে এখন আমি ক্লান্ত। বিচার চেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি। চার বছরে আমি শুধু পেয়েছি ‘বিচার হবে’ আশ্বাসটাই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছিলেন— বিচার হবে, তবে সময় লাগবে। আমি জানি না কত সময়? এ নিয়ে নতুন করে কোন কিছু বলার শক্তি আমার আর নেই। যদি আদালতে বিচার না পাই তবে আমি বেঁচে থাকতে মুখোশ টেনে খুলে দেব। আল্লাহ সব দেখতে পাচ্ছেন তাঁর উপরই ভরসা করে আছি।’
দিয়াজ হত্যার বিচারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে দিয়াজের মা বলেন, আমি বৃদ্ধ হয়েছি। সন্তান হারিয়েছি। আমিও আমার ছেলের কাছে চলে যাব। মরার আগে শুধু ছেলে খুনের বিচার দেখতে চাই।
দীর্ঘদিন বিচারহীন পড়ে থাকার বিষয়ে নিহত দিয়াজের বড় বোন অ্যাডভোকেট জুবাইদা সরওয়ার চৌধুরী নীপা বলেন, ‘ খুনিরা বড় বড় নেতার পাশে ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যায়। সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের পাশে তাদের প্রায় দেখা যায়। কিন্তু তারা পুলিশের খাতায় পলাতক। তাদের পাওয়া যাচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, তদন্তের অগ্রগতি বলতে সিআইডিতে ঘন ঘন তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়। তাঁরা তদন্তও করছেন না। আসামিদের মধ্যে চারজন— আনোয়ার, টিপু, জামশেদ ও জিসান হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছিল। পরে আনোয়ার নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বাকি তিন জন নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ না করায় তাদের বিরুদ্ধে আদালত পরোয়ানা জারি করে। বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে আগেই পরোয়ানা জারি হয়। অথচ পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না।
এদিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সংশ্লিষ্ট থানায় গেছে। গ্রেপ্তারের দায়িত্ব হাটহাজারী থানার। আমরা মামলার তদন্তকারী সংস্থা। গ্রেপ্তারের অথোরিটি আমাদেরও আছে তবে আমরা আসামিদের পাইনি। তাই গ্রেপ্তার করতে পারিনি। বাদিপক্ষ তাদের অবস্থান জানিয়ে আমাদের তথ্য দিলে আমরা অবশ্যই গ্রেপ্তার করব।’
প্রসংগত, ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর র্যাবের হাতে জি কে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবন নির্মাণের ৭৫ কোটি টাকার কাজ জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান সার্স দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স-জি কে বিল্ডার্স লিমিটেডকে (জেভি) পাইয়ে দিতে ‘বাধা অপসারণের অংশ হিসেবে’ ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজকে খুন করা হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় রিপোর্ট হওয়ার পর জিকে শামীমকেও মামরার আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে আবেদন করেছিলেন দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী।
মামলার আদ্যোপান্ত
দিয়াজকে পরিকল্পিতভাবেই খুন করা হয়েছিল। খুনের পর আত্মহত্যা সাজাতে একের পর পর এক ঘটেছিল অনেক ঘটনা।
লাশ উদ্ধার
ভবনের এক ভাড়াটিয়া সংবাদ দিলে ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর গভীর রাতে ছাত্রনেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে হাটহাজারী থানা পুলিশ। ওই সময়ে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই। লাশ উদ্ধারের ২২ ঘণ্টার মধ্যেই ফরেনসিক রিপোর্ট চলে আসে। তাতে বলা হয় ‘হত্যার আলামত পাওয়া যায়নি’। ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে আসার আগেই কয়েকজন আত্মহত্যার সংবাদ প্রচার করেন।
তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা
লাশ উদ্ধার ও প্রথম ময়নাতদন্ত রিপোর্টের পর দিয়াজ হত্যাকে ব্যক্তিগত খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল আসামিরা। থানায় বয়ান দিতে গেলে তারা প্রেমঘটিত বিষয়কে উল্লেখ করে সেটিকে কারণ দেখিয়ে দিয়াজ হত্যাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। ওই সময় আসামিরা মিডিয়ায় দেওয়া বক্তব্য ও ফেসবুকে প্রচার করেছিল ‘প্রেমঘটিত’ সমস্যায় আত্মহত্যা করেছিলেন ছাত্রনেতা দিয়াজ। ওই তথ্য ধোপে টেকেনি।
মামলা ও ফরেনসিক
লাশ উদ্ধারের পরদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে প্রথম ময়নাতদন্ত হয়। প্রতিবেদনে তাকে ‘হত্যার আলামত মেলেনি’ বলে উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখান করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন নিহত দিয়াজের পরিবার। এরপর ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর দশজনকে আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের হয়। দিয়াজের মা জাহেদা আমিনের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত দিয়াজের লাশ কবর থেকে তুলে পুনরায় পোস্টমর্টেমের আদেশ দেন। একই বছরের ১০ ডিসেম্বর লাশ তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসে ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই। ওই ফরেনসিক প্রতিবেদনে বলা হয়, দিয়াজের শরীরে আঘাত ও জখমের চিহ্ন আছে। হত্যার আলামত আছে এমন প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে হাটহাজারী থানায় হত্যা মামলা রেকর্ড হয়।
দিয়াজ হত্যার আসামিরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন
চবি ছাত্রলীগের সে সময়ের সভাপতি আলমগীর টিপু,
ছাত্রলীগ নেতা আবুল মনসুর জামশেদ
তাদের অনুসারী রাশেদুল আলম জিশান,
আবু তোরাব পরশ
মনসুর আলম
আবদুল মালেক
মিজানুর রহমান
আরিফুল হক অপু
মোহাম্মদ আরমান।
খুনের অভিযুক্তরা চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবেও পরিচিত।
তদন্ত
তদন্ত শুরু হয়েছিল হাটহাজারী থানার তৎকালীন ওসি বেলাল উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের হাতে। পরে মামলার তদন্তভার যায় সিআইডির কাছে। সিআইডির প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার অহিদুর রহমান তদন্ত শুরুর পর বদলি হন। এরপর থেকে আরও দুইজন তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। মামলার তদন্ত শুরুর পর থেকে সিআইডি শুধু ২০১৯ সালের ২০ মার্চ মোহাম্মদ আরমান নামে এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছিল। পরে আরমানও জামিনে বেরিয়ে যায়।