নারী মানে একটি বস্তু যার অনুভূতি থাকবে না। সে হবে শুধুই একটি জরায়ূ। নারী কেন তার মত প্রকাশ করবে। নারীর কথা বলাও একটি গুরুতর অপরাধ। ভাবছেন এ কেমন কথা? সত্যি নাকী? হ্যা, ১৬০০-১৭০০ শতাব্দীতে নারীর কথা বলাও ছিল প্রচণ্ড নিয়ন্ত্রিত। নিয়ন্ত্রণকামী পুরুষ সমাজ শুধু কথা বলার অপরাধেও নারীকে দিত কঠিন শারীরিক শাস্তি।
মধ্যযুগের নারী। তারা কতটা স্বাধীনতা বঞ্চিত ছিলেন, সেটি এই বিশের শতাব্দীতে হয়ত আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। সামান্য গল্পগুজবেও তাদের ছিল মানা। দাম্পত্য হোক বা সামাজিক কোন বিষয় হোক জনসমক্ষে কথা বলার অধিকার ছিল না নারীর। গসিপিং করা তো দূরের কথা নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি শব্দ উচ্চারণ হতে পারে কঠিন শাস্তির কারণ। বাক-স্বাধীনতা শব্দটির সাথে তারা ছিলেন নিতান্তই অপরিচিত।
কথা বলা নারীদের শায়েস্তা করতে সে সময়ে লোহার তৈরি এক ধরনের চোয়াল বন্ধনী (স্কোল্ড ব্রাইডল) পরানো হত। সেটি পরে থাকতে হতো কথনো কয়েক ঘণ্টা কখনও কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত চোয়াল বন্ধনীর মধ্যে বন্দি থাকতেন নারীরা। কখনও নারীকে বাইরে যাওয়ার সময় স্বামী পরিয়ে দিতেন চোয়াল বন্ধনী। নারী ছিল অনেকটা ঘৃণ্য পশুর মত।
এ শাস্তি দিতে কারা?
অপরাধী নারীর স্বামী ছিলেন প্রধানত শাস্তি দেওয়ার একচ্ছত্র মালিক। এছাড়াও সমাজের প্রবীণ ব্যক্তি ও ধর্মীয় নেতারাও এমন শাস্তি দিতে পারতেন নারীদের।
স্কোল্ড ব্রাইডল কী?
এটি ছিল লোহার তৈরি একটি চোয়াল বন্ধনী যা দুই দাতের পাটিকে আলাদা করে বেঁধে রাখত। কখনও এটির ডিজাইন অনেকটা মুখোশের মত। লোহার একটি ক্ষুদ্র অংশ জিভের উপর বসিয়ে দেওয়া হত। এটির চাপে কথা বলা একেবারে বন্ধ করা যেত। এটি এ সময়ে কখনও হয়ত ঘোড়ার মুখে দেখে থাকবেন।
কথা বলা যেভাবে অপরাধ
নারী কথা বলা মানে দুষ্টু জিহ্বার প্রভাব বেড়ে যাওয়া। খুব গুরুতর অপরাধের সাজা নয় বরং খুব সাধারণ ঘটনায় স্বামী চাইলে স্ত্রীকে পরিয়ে দিতে পারতেন চোয়াল বন্ধনী। মনে করুন কোন নারীর স্বামী দেখলেন স্ত্রী আড্ডা দিচ্ছেন—তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পরিয়ে দেওয়া যেত এ চোয়াল বন্ধনী। কিংবা স্বামীর সাথে একটু ন্যাকামো বা ঢং করেছেন সাথে সাথেই স্বামী পরিয়ে দিত চোয়াল বন্ধনী। সেটি পরেই তাকে দৈনন্দিন সব কাজ করতে হত।
মাঝে মাঝে শাস্তি হত কঠোর
স্ত্রীকে শায়েস্তা করতে বা সমাজের বিচারেও নারীকে পরানো হত এ লোহার বন্ধনী। কঠোর সাজা দিতে নারীকে কোন প্রকাশ্য স্থানে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হত। হেঁটে যাওয়া পথিকও তাকে থুঁতু দিয়ে ঘৃণা প্রদর্শন করত। ওই চোয়াল বন্ধনীর সাথে মাঝেমধ্যে একটি ‘ঘণ্টা বাঁধা হত। সেটি লাগানো থাকত শাস্তি পাওয়া নারীর ঠিক কাঁধের উপরের অংশে। এতে ওই নারী হাঁটার সময় শব্দ হত। এসব শাস্তির মাধ্যমে নারীকে শারীরিক লাঞ্ছনা ও সামাজিকভাবে অপমান করা হত।
নিয়ন্ত্রণকামী পুরুষ সমাজের হাতে অবজ্ঞা ও অপমানের বোঝায় ভরা একটি ভীষণ লজ্জার জীবন কাটাতেন সে দিনের নারীরা। সেটি তাদের কতটা শারীরিক ও কতটা মানসিক পীড়া দিয়েছে সে বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
ধর্ম ও নারীর বাক স্বাধীনতা
অপবিত্র নারীকে শুদ্ধ করার একমাত্র উপায় দৈহিক শাস্তি। দৈহিক শাস্তির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক হতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস ছিল। নারীর শরীরে যেহেতু অশুভ আত্মা ভর করে সেহেতু ওই সময়ের ধর্মগুলো বিশ্বাস করত কঠিন শরীরি শাস্তির মধ্য দিয়ে নারীকে প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধ বানানো যায়।
দুষ্টু জিহ্বার ডাইনি
সেদিনের সমাজ নারীকে বলত ঘৃণ্য ডাইনি, জাদুকরি বা অশুভ আত্মা। নারীদের পারস্পরিক ভাব আদান প্রদান কথা বলা বা স্বামীর সাথে ন্যাগিং করা, কাউকে বকাঝকা করা, সমালোচনা করাকে তারা বলত দুষ্টু জিহ্বার ডাইনি। তাই তারা নারীর মুখ বন্ধ রাখতে সচেষ্ট ছিল। নারীদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার জন্য ছিল নানা রকমের সরঞ্জাম। এ অত্যাচার ও অবমাননা সমাজে একেবারেই স্বীকৃত ছিল।
সে সমাজে নারীদের স্বামীর বিরুদ্ধে কোন কথা বলা, ধর্মীয় গুরুদের কোন বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করাকে দেখা হত গুরুতর অপরাধ হিসেবে।
কোথায় ও কখন এটির ব্যবহার ছিল?
১৬০০ থেকে ১৭০০ শতাব্দীতে এটির ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ওয়েলস ও জার্মানিতে এর বহুল ব্যবহার ছিল। নারীকে এ শাস্তি দিতে পারতেন স্থানীয় প্রবীণ ও তাদের স্বামীরা। পরে ১৯ শতকের দিকে এটির জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। পরে এ ধরনের শাস্তি বৈধতা হারায় দেশগুলোতে।