দেশিয় পোশাকের প্রতি ঝোঁক তার বাল্যকাল থেকেই। দেশিয় ছাড়া অন্য কোন পোশাক তেমন পরেন না। সবচেয়ে বেশি ঝোঁক ছিল জামদানিতে। নিজেও তিনি প্রচুর জামদানি শাড়ি পরেন। তার সব আবেগ যেন জামদানিতেই।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি প্রয়োজন ছাড়াই ঘুরতে যেতেন তাঁতিদের পল্লীতে। শুধু তাঁত নয় মিশে যেতেন তাদের সুখ দুঃখের সাথেও। তার মতে দেশিয় পোশাক নিয়ে শুধু আবেগ থাকলেই চলে না। এটিকে ফ্যাশনে নতুনত্ব এনে যুগোপযোগী করে তুলতে হয়। উইম্যান অ্যান্ড ই-কমার্স-উই ফোরামের (কার্যকরি কমিটি) সাবেক পরিচালক কাকলি রাসেল তালুকদারকে অনেকেই চেনে জামদানি রানি হিসেবে। জামদানি শাড়ির ব্যবসার পাশাপাশি তিনি ফেসবুকে ‘ডিজিটাল স্কিল’ বিষয়ক লেখালেখিও করেন।
২০১৯ সালে কাকলি’স অ্যাটায়ার নামে একটি ফেসবুক পেজ খুলে ১ বছরে তিনি বিক্রি করেছেন প্রায় ১৯ লাখ টাকার জামদানি শাড়ি। নরসিংদীর মেয়ে ও চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর বধূ কাকলি বলেন— উইয়ের রাজিব স্যারের কাছে শিখেছি কীভাবে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং করতে হয়। অনুধাবন করেছি মানুষ যাকে চেনে তাকেই বিশ্বাস করে ও তার কাছেই কেনে। জামদানিকে আমি মধ্যবিত্তের ক্রয়সীমায় আনার চেষ্টা করছি। জামদানি দিয়ে পোশাকে ফিউশন আনারও চেষ্টা থাকবে ভবিষ্যতে। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মানুষের হাতে পৌঁছে দিতে চাই তাঁতির হাতে তৈরি আসল জামদানি ।
উইম্যানভয়েসবিডি:শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
কাকলি রাসেল তালুকদার: ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউ আই ইউ) থেকে বিবিএ শেষ করে একটা ইন্সস্টিটিউশনে ই-কমার্স এবং ফিন্যান্স বিষয়ে ৫ বছর শিক্ষকতা করি। সাংসারিক দায়িত্বের কারণে এমবিএটা অসমাপ্ত থেকে যায় চাকরিটাও ছাড়তে হয়। তার পরবর্তী দু বছর খুব হতাশায় কাটে। পরে বাবা মা ভাইদের উৎসাহে আবারও নিজে কিছু একটা করার সাহস আসে। ভাইয়ের কাছে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ২০১৯ সালের জুন মাসে কাকলি’স অ্যটায়ারের উদ্যোগ নিই।
উইম্যানভয়েসবিডি: এক বছরে ১৮ লাখেরও বেশি টাকার বিক্রি। সেটা কীভাবে সম্ভব?
কাকলি রাসেল তালুকদার: সেটি হল পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং। আমি উই থেকে ই-কমার্স বিজনেসে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের গুরুত্ব জেনেছি। অনলাইন ব্যবসায়ে ব্র্যান্ডিংয়ের সাথে এই ব্যক্তিগত পরিচিতর বিষয়টাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার সাথে জরুরি হল একটি কাজের স্কিল বা সে বিষয়ক সম্যক জ্ঞান বা পারদর্শিতা। প্রতিদিন পড়তে হয় জানতে হয়। আমি মনে করি হঠাৎ করে ধারণা ছাড়া কোন ব্যবসা নিয়ে বসে গেলে সেখানে সফল হওয়া কঠিন বা হতাশ হতে হয়। আমাকে আমার পড়া জানা ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
উইম্যানভয়েসবিডি: জামদানি শাড়ি কেন বেছে নিলেন?
কাকলি রাসেল তালুকদার: ছোটবেলা থেকেই জামদানি র প্রতি ভালোলাগা এবং প্যাশন ছিল। কোন কারণ ছাড়াই জামদানি র ব্যাপারে জানার চেষ্টা করে এসেছি দীর্ঘ ৭ বছর । এ ৭ বছরের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করেছি। সবচেয় বড় ব্যপারটা ছিল আমি জানতাম আমি কী করছি। জামদানি আমাদের দেশের সম্পদ। এটি যেমন এক্সক্লুসিভ ঠিক তেমনই চ্যালেঞ্জিং। আমি বিশ্বাস করেছি যে বিষয়ে আমার আগ্রহ ভালো লাগা সেটিকেই আমি পেশা করে নিই। তাই নিয়েছি। আমি বলব ব্যবসার জন্য ধৈর্য্য হচ্ছে সবচেয়ে বড় মূলধন।
উইম্যানভয়েসবিডি: আসল জামদানি মেলে লাখ টাকায় অন্য জামদানি গুলো আসল নয় এম কথা শুনি প্রায়। তবে আপনার কী সব লাখ টাকার ক্রেতা?
কাকলি রাসেল তালুকদার: আসলে এগুলো হল জামদানি মিথ। জামদানি লাখ টাকার হতে পারে আবার ৩ হাজারও হতে পারে। দাম নির্ভর করে জামদানি তে ব্যবহৃত সুতো, রং, ডিজাইন ও বুননের উপর। তবে একটি কথা ঠিক যে জামদানি একেবারে সস্তায়ও মেলে না। একটি শাড়ি বুনতে তাঁতিদের অনেক সময় এক সপ্তাহও লেখে যায়।
তবে শুধু উচ্চবিত্ত শ্রেণির নারীরাই আসল জামদানি পরবেন এ বিষয়টিকে আমি বদলে দিতে চেয়েছি। তাঁতির হাতের বানানো আসল জামদানি আমি তুলে দিয়েছি মধ্যবিত্তের হাতেও। আমি ৩০০০-৪০০০ টাকায়ও আসল জামদানি বিক্রি করেছি। সাধারণের হাতে তুলে দিতে চেয়েছি আসল পণ্য।
উইম্যানভয়েসবিডি: খোলা বাজারে পাওয়া জামদানি ও তাঁতির জামদানির মধ্যে কী বিশেষ কোন পার্থক্য আছে?
কাকলি রাসেল তালুকদার: জামদানি হল আমাদের দেশের সংস্কৃতি আমাদেরই ঐতিহ্য। তার আসল নকল আমাদেরই বুঝে নিতে হবে। জামদানি র ডিজাইন ফ্যাক্টরির মেশিনে করে নিলে সেটাকে তো ঢাকাই জামদানি বলা যাবে না, তাই না? আর সেখানে জামদানির বিশষত্বও থাকে না।
দেশি জামদানি গুলো কার্পাস জাতীয় তুলোকে সুতো বানিয়ে তাও বিশেষ প্রক্রিয়ায় রং করে রোদে শুকিয়ে তবেই তাঁতে ফেলা হয়। ঢাকাই জামদানি পাবেন কটন, হাফসিল্ক ও রেশম সুতোয় বোনা। হাতে বোনা জামদানি র চকচকে রং থাকে না। আসল জামদানি র রংগুলো চাকচিক্যহীন তবে চোখ জুড়িয়ে যায়।
অন্যদিকে ইন্ডিয়ান জামদানি র সুতা হবে নায়লন জাতীয় সুতো।
চকচকে রং থাকলেও একটি আঁশ ধরে যদি টান দেন জড়িয়ে যাবে জমাট হয়ে যাবে। আর যদি পোড়ান সেটা জ্বলে যাবে না। প্লাস্টিক পোড়ার মত দলা হয়ে যাবে। অন্যদিকে আসল জামদানি টান দিলে জড়াবে না। পোড়ালে ছাই হয়ে যাবে। ইন্ডিয়ান মেশিনে তৈরি জামদানির উল্টোপিঠ খসখসে হবে। এছাড়াও অনেক বিষয় আছে অনুভবের। হাতে বোনা শাড়িটি যে কমফোর্ট দিতে পারে অন্যটি তা পারে না।
উইম্যানভয়েসবিডি: মানুষ চাইলে শপিং সেন্টার থেকে বা বুটিকশপ থেকে দেখে যাচাই করে কিনতে পারে। একটি পেজকে বিশ্বাস করা অনেক সময় কঠিন। নিজের কোন আউটলেট ছাড়া শুধু অনলাইনের বিক্রি করে কী সফল ব্যবসায়ী হওয়া সম্ভব?
কাকলি রাসেল তালুকদার: আসলে ব্যবসা বিষয়টি বিশ্বাসের। আপনি আউটলেটে কেন কিনতে যাবেন? কারণ সেটি অনেকদিন ধরে আছে ও সেটি একটি সুনাম অর্জন করেছে তাই না? অনলাইন ব্যবসাটিও ঠিক তাই। এখানে আউটলেট নয় সুনামটাই হল প্রথম ব্র্যান্ডিং। আমরা আরও একটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিই সেটি হল পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং। যাকে মানুষ চিনবে যে মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে তার কাছেই কিনবে। যেমন ধরুন শুধু একটি পেজ হলে সেখানে একটি কমিউনিকেশন গ্যাপ থাকে, অবিশ্বাস তৈরির সুযোগ থাকে পারসন টু পারসন কমিউনেকশন মানে হল পণ্যের সোথে নিজের বিশ্বাসের ব্র্যান্ডিং। এতে ব্যবসার একটি স্থায়ী ব্যাকগ্রউন্ড তৈরি হয়।
উইম্যানভয়েসবিডি: ভবিষ্যতে কী আউটলেট দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন?
কাকলি রাসেল তালুকদার: শুরুতে আউটলেট করার চিন্তা ভাবনা থাকলেও এখন একেবারেই বাদ দিয়েছি। কারণ উইতে রাজিব স্যারের কল্যাণে শোরুম দেয়ার দুঃস্বপ্ন নিয়ে অনেকের নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার গল্প আমি জানি।
উইম্যানভয়েসবিডি: পরিবারের সমর্থন পেয়েছিলেন?
কাকলি রাসেল তালুকদার: হ্যা পুরোপুরিই। বাবা মা ভাই ও স্বামীর পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি। আসলে পরিবার বাধা দিলে যে কোন কাজ একটু কঠিন হয়ে পড়ে। মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক সময় সেটি অসম্ভব হয়ে যায়।
উইম্যানভয়েসবিডি: বাংলাদেশে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার ভবিষ্যত কী?
কাকলি রাসেল তালুকদার: অনলাইন ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপারে বলব বিশ্বের সব চেয়ে বড় মার্কেট হচ্ছে অ্যামাজন এবং ধনী ব্যক্তিটি হচ্ছেন তার কর্ণধার জেফ বেজোস। তার মানে হলো এখন অনলাইন মার্কেটেরই যুগ। দিনে দিনে অনলাইন মার্কেট বড় হবে। কারণ মানুষ এখন সময় সচেতন। অফলাইন মার্কেটে যাওয়া মানে ৩-৪ ঘণ্টা সময় নষ্ট। এর থেকে বিনা ঝামেলায় ভালো মানের পণ্য এবং সার্ভিস ঘরে বসে পেলে বাইরে যেতে চাইবে না । উন্নত বিশ্বে এই প্র্যাকটিস চলছে। আর আমাদের দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইন শপিং-ই ভরসা। করোনায় অনেকে বাধ্য হয়ে অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটা করলেও একটা সময় তারা অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
উইম্যানভয়েসবিডি: এখন তো সবাই পেজ খুলে ব্যবসা করতে চায়। তাদের কী পরামর্শ দেবেন?
বিক্রির পদ্ধতিটি ছাড়া অনলাইন বা অফলাইন ব্যবসা আসলে একই। পণ্য সম্পর্কে ধারণা ও জ্ঞান ছাড়া কোন ব্যবসায় হাত দিলে হতাশই হতে হবে। একাডেমিক শিক্ষায় চার বছর বা সাত বছর ধৈর্য্য রাখতে পারলে ব্যবসায় কেন পড়াশোনা ছাড়াই শুরু হবে বলুন। আমি নতুনদের পর্যবেক্ষণ করতে পরামর্শ দিই। সম্যক জ্ঞান ও ধৈর্য্য নিয়ে শুরু করলে সফলতা মিলবেই।
এসএস