ধর্ষণে ভূমিষ্ট শিশুর দায়িত্ব সরকারের, থাকছে গর্ভপাতের অধিকারও
বাংলাদেশে কোন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে সন্তান হলে সে সন্তানের সন্তানের দায়িত্ব নেবে সরকার। ধর্ষকের সম্পদ থেকে ভরণপোষণের ওই টাকা আদায় করা হবে। এছাড়াও অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ১০ সপ্তাহের মধ্যে ভিকটিমের গর্ভপাতের অনুমতি থাকবে। প্রস্তাবিত ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০২১’- এমন বিধান রাখা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার নারীর সন্তান বেড়ে উঠবে মায়ের পরিচয়ে। প্রস্তাবিত ‘নারী শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০২১ আইনটিকে দেশের বিচার বিভাগের জন্য মাইলফলক বলছেন আইন সংশ্লিষ্টরা।
ধর্ষণের শিকার হয়ে মা হওয়া একজন নারী বলেছেন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক), ‘ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রথমেই মামলা দায়ের করিনি। সামাজিক শালিসের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলছিল। তখন আমি চারমাসের অন্তসত্ত্বা। ওই শালিসে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সন্তান ভূমিষ্ট হলে তার মুখের আদল যদি ধর্ষকের সাথে মিলে যায়। তবেই ধর্ষককে আমার সাথে বিয়ে দেওয়া হবে। নয়ত এটি ধর্ষণ নয়। তখন ভাবছিলাম ওই সন্তানকে আমি কোথায় নিয়ে যাবি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সেটি গর্ভপাত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমার পরিবার। ওই সময়ের কথা আমি মনে রাখতে চাই না।’
আইন সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মাতৃত্ব গৌরবের হলেও আমাদের সমাজের প্রেক্ষিতে ধর্ষণের শিকার নারী কিংবা কিশোরীর জন্য সেটি লাঞ্ছনার, শিশুটির শৈশব কাটে অসহনীয় অপমান আর লাঞ্ছনায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন শিশুরা মানসিক পীড়ায় বড় হয়। সমাজে ভুক্তভোগী তার অনাগত শিশু উভয়ের ভবিষ্যতই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
বিচারের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হলেও মামলার নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর পার হয়। ততদিনে ভিকটিম পরিবার মামলা ও হয়রানিতে নিঃস্ব হয়ে যান। অনেক ক্ষেত্রেই মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন। আবার কখনও জামিনে বেরিয়ে ধর্ষক দেখাতে থাকে রক্তচক্ষু।
এমন অবস্থায় ধর্ষণের শিকার নারী আর তার সন্তানের সুরক্ষায় নতুন আইন পাসের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে ধর্ষণের শিকার নারীর সন্তান শুধু তার মায়ের পরিচয়েই পরিচিত হবেন। আর শিশুটির ২১ বছর পর্যন্ত সরকার তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে। ওই অর্থটি আদায় করা হবে ধর্ষকের কাছ থেকে।
‘নারী শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০২১’—খসড়া আইনটিতে বলা হয়েছে, ‘ধর্ষণের কারণে অন্তঃসত্ত্বা হলে গর্ভধারণের ১০ সপ্তাহের মধ্যে স্বেচ্ছায় ভুক্তভোগী গর্ভপাত করাতে পারবেন।’
দেশের বিচার বিভাগের জন্য এ আইনকে মাইলফলক বলে জানিয়েছেন আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শাসমুদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এই আইনটা আরো আগে করা প্রয়োজন ছিলো। কেউ যদি ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃস্বত্বা হয়ে যান তাহলে বাচ্চার দায়িত্বভার বহন তার জন্য বোঝা।’
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আইনটি বাস্তবায়ন হলে ধর্ষণের শিকার নারী ও তার সন্তানের সুরক্ষা অনেকাংশে নিশ্চিত হবে।’
আইন কমিশনের প্রস্তাবিত আইনটি সংসদে বিল আকারে উপস্থাপনের জন্য পাঠানো হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আইন এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে।
চট্টগ্রামের প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট দিল আফরোজ বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীরা সারাজীবন ধরেই হেনস্থার শিকার হন। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীরা সন্তানসম্ভবা হলে সেক্ষেত্রে আমরা ডিএনএ টেস্টের আবেদন করি ও ধর্ষকের বিচার চাই। ধর্ষণের শিকার হয়ে ভূমিষ্ট হওয়া শিশুর অধিকার রয়েছে বাকি শিশুদের মতই। নতুন প্রস্তাবিত এ আইনে রাষ্ট্রই শিশুটির দায়িত্ব নেবে। এটির বাস্তবায়ন হলে অনেক শিশুই মর্যাদা নিশ্চয়তার একটি শৈশব পাবে।’