রেহানা কি নারীবাদী?
না।
নারীবাদের সাথে রেহানার দূরতম সম্পর্কও নাই। রেহেনা মরিয়াম নূর দেখে আমার মনে হয়েছে যে, যদি পরিচালক সা’দ আমাদের কোন নারীবাদীর গল্প বলার চেষ্টা করে থাকেন, যদি তিনি রেহানাকে একজন নারীবাদী হিসেবে পোট্রেইট করে থাকেন তাহলে বলবো নারীবাদ নিয়ে ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তিকর এবং অসত্য বার্তা তিনি দেয়ার চেষ্টা সফলভাবে করেছেন। রেহানাকে “নারীবাদী” হিসেবে পোট্রেইট করছেন। যেখানে নারীবাদী মানে বদরাগী, অযৌক্তিক, অবসেসিভ, ইগোটিক, পুরুষবিদ্ধেষী, প্রতিশোধপরায়ণ ইত্যাদি ইত্যাদি…যা কিনা বহুছর ধরে বহুভাবে আমাদের পুরুষনিয়ন্ত্রত গণমাধ্যম চেষ্টা করে আসছে। এবং এদেশের নারীবাদীরা রেহানাকে নারীবাদী হিসেবে একনলেজ (স্বীকৃতি) করেছেন। এখানেই সা’দ ভয়ঙ্করভাবে সফল।
রেহানার ইগো এবং অবসেসিভ কম্পালশন তাকে এতোটাই প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলে যে, সে যাকে ভিকটিম মনে করছে তার স্টেটমেন্টও সে আমলে নেয় না। এবং শেষ পর্যন্ত তার অসম্ভব নীতি নৈতিকতার বিপরীতে গিয়ে পুরুষ কলিগটাকে এ্যাকিউজ করার জন্য চুড়ান্ত রকমের মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এবং শেষপর্যন্ত আপোষ করতে বাধ্য হয়। একজন বিপ্লবী কি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে প্রতিবাদ করে?
রেহানা মরিয়াম নূর এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে আমরা অটিজমে আক্রান্ত একজন নারীর মানসিক সংকট দেখেছি যে কিনা অ্যাসপারজার নামক অটিজমে আক্রান্ত। এ ধরনের মানুষের চাইল্ডহুড ডেভেলভমেন্টে ত্রুটি থাকে যার ফলে মানুষটি অপটিমাল সোশ্যাল বিহেভিয়ারে ব্যর্থ হয়, আশেপাশের মানুষের মনোভাব, মানসিক অবস্থা এবং ইনটেনশন (উদ্দেশ্য) বুঝতে পারেনা। বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে পড়লে এরা কোন ধরণের সোশ্যাল কমিনিউকেশন করতে পারেনা এবং অনিচ্ছাকৃত ভাবে ভুল জায়গায় ভুল রীতিনীতি প্রয়োগ করে।
রেহানা একই সাথে অ্যাসপাজার এবং ওসিডি (অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার) আক্রান্ত হবার কারণে সে তার চিন্তা ও কাজ কর্মে যুক্তিহীন অবসেশন (অনর্থক চিন্তার পুনরাবৃত্তি) এবং কম্পালশন (সেই চিন্তা অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া) এর বৃত্তে আটকে থাকে। ফলে, সে জানেনা তার ফোকাস কি, সে কি করবে, কেন করবে। সে হতাশ হয়, এই হতাশা তাকে এ্যারোগেন্ট (উগ্র) করে।
রেহানা একজন সিঙ্গেল প্যারেন্ট। যদিও আমরা জানিনা রেহানার স্বামী মারা গেছেন নাকি ডিভোর্সড। পরিবারের মেজর উপার্জন সেই করে। স্বাভাবিকভাবেই স্ট্রেসড। কর্মক্ষেত্রেও সে ভীষণ নীতিবাগিস একজন শিক্ষক। কী কর্মক্ষেত্রে, কি মাতৃত্বে তার সমস্ত চিন্তা এবং ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া তার ইগোকে স্যাটিসফাই করে।
মা হিসেবে সে অসচ্ছ, গোঁয়ার এবং ভীতু। গোঁয়ার বলেই নিজের শিশুকন্যাকেও প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে। ভীতু বলেই সে মেয়েকে স্কুল শো-তে পারফরম না করার সিদ্ধান্তের পেছনের কারণটা খুলে বলতে এবং মেয়েকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদার করতে ভয় পায়। বরং ভয়ঙ্কর একটা মাইল্ড গেইম খেলে মেয়েকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার শর্ট গেইম খেলে। একজন নারীবাদী কি কখনো এমন শর্টপাসে খেলে? রেহানার ভাই শেষে তাকে যে প্রশ্নটি করে যে, “তুমি আসলে এইটা কার জন্য করছো? ইমুর জন্য নাকি তোমার নিজের জন?”, এই প্রশ্নটিই মুলত রেহানা।
আমরা দেখি একজন অবসেসিভ নীতিবাগিস রেহানাকে, যার কাছে বাচ্চার স্কুলে প্যারেন্ট মিটিং এ যাওয়ার সময় হয় না, বাচ্চার ক্লাসটিচারের সাথে দেখা করার চাইতেও তার জন্য জরুরি হয়ে ওঠে ছাত্রীর স্যাক্সুয়াল হ্যারেজমেন্টের প্রতিবাদ করা। যদিও সে জানেনা যে, ছাত্রীটি প্রফেসরের হাতে এবিউজ হয়েছে নাকি মিউচুয়াল বেনিফিটের সম্পর্কে ছিলো। কিন্তু রেহানার ইগো এবং অবসেসিভ কম্পালশন তাকে এতোটাই প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলে যে, সে যাকে ভিকটিম মনে করছে তার স্টেটমেন্টও সে আমলে নেয় না। এবং শেষ পর্যন্ত তার অসম্ভব নীতি নৈতিকতার বিপরীতে গিয়ে পুরুষ কলিগটাকে এ্যাকিউজ করার জন্য চুড়ান্ত রকমের মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এবং শেষপর্যন্ত আপোষ করতে বাধ্য হয়। একজন বিপ্লবী কি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে প্রতিবাদ করে?
সিনেমার গল্পে পরিচালকের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হওয়া উচিত। আমরা শুরুর দিকে দেখি রেহানা পারফেক্টলি অযু করছেন, নামাজ পড়ছেন এবং রেহানা মাথায় কাপড় দেন। তার মানে সে একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম। এখন পুরা গল্পের সাথে বা রেহানার স্ট্রাগলের সাথে প্র্যাকটিসিং মুসলিম হওয়ার প্রয়োজনটা কোথায় সেটা আমরা বুঝে ওঠতে পারিনাই। নাকি সা’দ খুব সুক্ষ্মভাবে একজন মডারেট মুসলিমকে ফেমিনিজমের ইডিওয়ালাইজ করেছেন, যেখানে একজন ঘোমটা পরা, আপোস না করা, নামাজ পড়া নারীর মুখ দিয়ে “খেলার কোন ছেলে মেয়ে নাই” এর মতো বহুল বর্ণিত একটি নারীবাদী বার্তা বসিয়ে দিয়ে ইসলামিক ফেমিজিমের দরজায় টোকা দিলেন!
সিনেমার গল্পে পরিচালকের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হওয়া উচিত। আমরা শুরুর দিকে দেখি রেহানা পারফেক্টলি অযু করছেন, নামাজ পড়ছেন এবং রেহানা মাথায় কাপড় দেন। তার মানে সে একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম। এখন পুরা গল্পের সাথে বা রেহানার স্ট্রাগলের সাথে প্র্যাকটিসিং মুসলিম হওয়ার প্রয়োজনটা কোথায় সেটা আমরা বুঝে ওঠতে পারিনাই।
আবার হাসপাতালের দৃশ্যে কোনও আগপাশ ছাড়া সাতমিনিট ব্যপী একটি ফেমিনিজমের ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে টুক করে ভাবীর মুখ দিয়ে রেহানার সাজ্জাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নাকফুল পরাকে “ভালোকাজ” হিসেবে তকমা দেওয়া এবং রেহানার তা মেনে নেওয়ার মাধ্যমে কোন বার্তা দিলেন সা’দ সেই আলোচনাও ভীষণ প্রাসঙ্গিক। অন্তত সা’দের গ্রুমিং এবং সারাউন্ডিং যারা জানেন তাদের কাছে এই প্রশ্নগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নারীবাদী রাজনীতির প্রতিপক্ষ তো সকলেই।
এক ঘন্টা সাতচল্লিশ মিনিটের এই সিনেমায় পরিচালক বা স্ক্রিপ্ট রাইটার কী গল্প বলতে চেয়েছেন আমি বুঝতে পারিনাই। সিঙ্গল মাদারের প্যারেনিটিং স্ট্রেস? কর্মক্ষেত্রে যৌননিপিড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? ছেলে শিশু আর মেয়েশুশিুর প্রতি স্কুলের বৈষম্য? আরো জানিনা রেহানা কেন তার ওয়ার্কপ্লেসে দিনের পর দিন থাকে! মেকিং কস্ট কমানোর জন্য? জানিনা। অবশ্য এই না জানাটাই হয়তো শিল্পকলা। “কোথায় মাথা কোথায় গলা/ সকল কথা যায়না বলা/ বললে পরে ভার কমে যায়/ না বলাটাই শিল্পকলা”!
সিনেমা নিয়ে যেহেতু আমার পড়াশোনা নাই সেহেতু পুরা সিনেমাজুড়ে ক্যামেরার কাঁপাকাঁপি নিয়ে আলাপ করতে চাইনা। তবে ভীষণ বিরক্তিকর ছিলো এই অহেতুক সাসপেন্স এর চেষ্টা। তারচেয়েও বিরক্তিকর ছিলো জোর করে ডিপ্রেশন আনার জন্য নীল করে ফেলা। ইদানিং এইটাই মনে হয় ট্রেন্ড।
এরপরেও আপনারা হলে গিয়েই সিনেমাটা দেখবেন প্লিজ। কেন দেখবেন?
বাঁধনের অভিনয় দেখার জন্য। একজন কাঁচা গল্পকারের আধাখেঁচড়া একটা গল্পকে পুরোপুরি সিনেমা বানিয়ে তুলেছে শুধুমাত্র বাঁধন। বাঁধনের অভিনয়ে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে কম্পিট করার দরকার নাই।
“রেহানা মারিয়াম নূর” টিমের জন্য শুভকামনা।
লেখক
সাদিয়া নাসরিন
প্রধান নির্বাহী
সংযোগ বাংলাদেশ