নারী গৃহশ্রমিকের হাতে উৎপাদিত ৩০ হাজার মাস্ক ছড়িয়েছে মানুষের মুখে মুখে। মন্ত্রণালয়সহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিদেশেও যাচ্ছে এ মাস্ক।
‘নিজের উদ্যোগে করোনায় অর্থকষ্টে থাকা মানুষদের সাহায্য করেছি। লকডাউনের সময়টাতে বুঝেছি একা হাতে সবাইকে সাহায্য করা প্রায় অসম্ভব। কয়েকজন কাজ হারানো গৃহকর্মীদের নিয়ে রি-ইউজেবল মাস্ক বানানোর ছোট্ট একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এটা শুধুই একটা ঝুঁকিপূর্ণ স্বপ্ন ছিল সে সময়ের জন্য। গৃহকর্মীদের পরিবারের জীবিকার ব্যবস্থা করতে ও সাধারণ মানুষের কোভিড-১৯ এর সুরক্ষার বিষয়টি ছিল মুখ্য। একটা টিম হয়ে আমরা ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত অবর্ণনীয় পরিশ্রম করেছি। আজ সে স্বপ্ন বাস্তব হয়ে পাখা মেলেছে। আমি জানি, স্বপ্ন আমি দেখলে সেটা ‘আমাদের’ হয়ে দেখি। আজ মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে এ স্বপ্ন বুনন।’
কথাগুলো বলছিলেন সংযোগ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সাদিয়া নাসরিন।
করোনাকালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ত্রাণ দিয়েছেন। যাদের খাদ্য দরকার তাদের খাবার ও যাদের অর্থ প্রয়োজন তাদের টাকা দিয়ে সহায়তা করেছেন। পুরো লকডাউনের সময় জুড়ে অন্তত ৫৭০ পরিবারকে সাহায্য করেছেন তিনি। করোনা পরিস্থিতিতে তারপর যে উদ্যোগ নিলেন সেটি একেবারেই অন্যরকম। কোভিড-১৯ সংক্রমণের ভয়াবহ এ সময়ে তিনি সুরক্ষিত ও সুলভ মূল্যে মাস্ক উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন। লকডাউনে কাজ হারানো নারী গৃহশ্রমিকরাই হলেন তার মাস্ক তৈরির কর্মী।
প্রাথমিকভাবে ৩০ হাজার মাস্ক বিক্রয়ের পর নতুন করে আরও ৩০ হাজার মাস্ক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
কীভাবে এ অন্যরকম উদ্যোগের শুরু?
সাদিয়া নাসরীন: লকডাউনে অনেককেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে খাদ্য ও অর্থ সহায়তা দিয়েছি। তবে এত মানুষের খাদ্য ও নগদ অর্থ সংকট একা ব্যাক্তির পক্ষে মেটানো অসম্ভব। এজন্য কিছু কার্যকর উদ্যোগের প্রয়োজন অনুভব করেছিলাম। আবার এ সময়ে মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রীর দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে।
এই মাস্ক উৎপাদনের মজুরির সাথে লভ্যাংশের ৩০ ভাগ সরাসরি উৎপাদনে অংশীদার নারীদের জীবিকার জন্য যাচ্ছে। লভ্যাংশের ৭০ ভাগ যাবে করোনা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের খাদ্য ও নগদ অর্থ সহায়তার কাজে।
খুব ছোট আকারে হলেও এ উৎপাদন ও বিপণনের সাথে জড়িত একটি সাপ্লাই চেইন সচল থাকবে যা কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকেও টিকে থাকতে সাহায্য করবে।’
এ মাস্ক কর্মহীন নারীর বিকল্প কর্মসংসংস্থান
সাদিয়া নাসরীন: সংযোগ বাংলাদেশ এ মাস্কের বিক্রয়, বিপণন ও বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাচ্ছে। কারণ, উৎপাদনের প্রাথমিক পুঁজি সংযোগ বাংলাদেশ দিলেও এটি মূলত কর্মহীন নারীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান কার্যক্রম। তারা লাভের অংশীদার। সংযোগ বাংলাদেশ কেবল প্রাথমিক পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। নারীদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে এ মাস্কগুলো বিনামূল্যেও বিতরণ করা হয়েছে সংযোগ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী শিশু, কিশোরী, নারী ও তাদের পরিবারের সদস্য, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, রিকশাচালক, গৃহকর্মী, পরিবহন শ্রমিক, বাসাবাড়ির নিরাপত্তা কর্মী এবং ভ্রাম্যমাণ ও স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে।
কতটা নিরাপদ এ মাস্ক?
সাদিয়া নাসরিন: এটি বারবার ব্যবহারযোগ্য ও ধোয়া যাবে এমন ফেসিয়াল মাস্ক। ১৬০-১৮০ জিএসএমের গেঞ্জির কাপড় ২ লেয়ার ব্যবহার করা হয়েছে। এটি করোনার ড্রপলেটসসহ বাতাসে থাকা ক্ষতিকর প্যাথোজেন আটকাবে শতকরা ৯৮ ভাগ । দৈর্ঘ্যে এ মাস্ক ১৪ সেমি, প্রস্থে ১২.৫-১৩ সেন্টিমিটার। মাস্কের মাঝামাঝি একটা কার্ভ (২.৫ সেমি) দেওয়া হয়েছে যাতে মাস্ক পরে কথা বলতে অসুবিধা না হয়। ব্যবহার করে ফেলে দিতে হবে না বিধায় পরিবেশ দূষণ করে না। ’
তবে এটি হাসপাতালে ব্যবহারের জন্যে উপযোগী নয় বলে জানিয়েছেন সাদিয়া নাসরীন।
গৃহশ্রমিকের তৈরি মাস্ক সাফল্য পেল?
সাদিয়া নাসরিন: প্রাথমিকভাবে ৩০ হাজার মাস্ক উৎপাদনের জন্য পুঁজি, মেশিনারিজ, টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে রোটেশনে ৫০ জন মেয়েকে কাজে যুক্ত করেছি। ওরা সবাই গৃহকর্মী। ব্যাক্তি পর্যায় ছাড়িয়ে এখন এই মাস্কের চাহিদা আসছে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে। দেশ ছাড়িয়ে নিউইয়র্ক, কানাডা, লন্ডনেও যাচ্ছে আমাদের অনভিজ্ঞ মেয়েদের অদক্ষ হাতের বানানো সুনিপুণ ফেইস মাস্ক।
প্রাথমিকভাবে উৎপাদিত ৩০ হাজার মাস্ক বিক্রি হয়ে গেছে। পুনরায় আরও ৩গ হাজার মাস্ক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি এ মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানে। সেনাবাহিনীর এনডিসি, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছাড়াও এ মাস্ক পৌঁছে গেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয, প্রাইম ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ট্রান্সকম গ্রুপ, ইউনিটেক্স গ্রুপ, শরিয়তপুর ডেপেলপমেন্ট সোসাইটি, আভাস, বরিশাল, রায়হান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, ঢাকা কর্পোরেশন বাংলাদেশ, এক্সপো ফ্রেইট লিমিটেড।
ওই মাস্কে গৃহকর্মী নারীর যত্ন ও শ্রম গেঁথে আছে প্রতি সেলাইয়ের ফোঁড়ে।
উল্লেখ্য, বেশিরভাগ গবেষণা বলছে গেঞ্জির কাপড় এক স্তরযুক্ত (লেয়ার) হলে ৪০ শতাংশ ড্রপলেটস আটকাতে পারে। কিন্তু ২ স্তর কাপড় দিলে এটি ৯৮ শতাংশ ড্রপলেটস আটকাতে পারে। সহজে শ্বাসও নেওয়া যায়। সার্জিক্যাল মাস্ক ড্রপলেটস আটকাতে পারে ৯৬ শতাংশ। এটি শুধু একবারই ব্যবহার করা যায়। তিন পরতে গেঞ্জির কাপড় দিলে হাঁচি-কাশি থেকে আসা জীবাণু আরও বেশি আটকানো যায়। তবে এটি মেডিকেলে ব্যবহার উপযুক্ত নয়।