আজ নীরার তৃতীয় বিয়ে । যদিও আত্মীয় -স্বজন , পাড়া প্রতিবেশী সবাই জানে ওর প্রথম বিয়ে। বাবা মা আর দুই ভাই জানে দ্বিতীয় বিয়ে। একমাত্র নীরা ছাড়া এখানে আর কেউ জানে না যে, আজ ওর তৃতীয় বিয়ে।
একমাত্র মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে সারা বাড়ি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের আগমনে বিয়ে বাড়িতে উৎসব শুরু হয়ে গেছে। শুধু মাত্র নীরার ভিতরেই বিয়ে নিয়ে কোনো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কিছুই নেই। থাকবেই বা কিভাবে? এতো আর নতুন না যে , নতুন নতুন স্বপ্ন বুনতে হবে। সেসব তো আগেই বোনা শেষ এখন শুধু ফসল ফলানো বাকি। সবার সাথে হেসে খেলে কথা বলে যাচ্ছে।
নীরার এক চাচাতো বোন তো বলেই ফেললো —কিরে! একটু পর তোর বিয়ে তোকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তোদের বাড়ির অন্য কারও বিয়ে।
নীরা বললো—এখন কি করলে তোর মনে হবে যে আমার বিয়ে ? বল তাই করছি।
বলে কথা ঘুরিয়ে ফেললেও মনে মনে ভাবছে আসলেই কি মনে হচ্ছে না আমার বিয়ে ? একবার আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলো। তবে এইবারই প্রথম নীরা বিয়ের কনে সাজে সবার সামনে কবুল বলবে। একটু পরেই বের হতে হবে পার্লারে সাজতে।
টানা পাঁচ বছর ধরে প্রেম করার পর প্রেমিক রবিনকে গোপনে বিয়ে করেছিলো নীরা কাজী অফিসে গিয়ে। ওই বিয়েটা ছিল দু’বছর আগে। সে কি ভয় আর লজ্জা! দুটোই মনের মধ্যে রেখে বিয়েটা সাহস করে করেই ফেলেছিলো। দুজনের চাওয়া পাওয়া এতোটাই বেড়ে গিয়েছিল যে বিয়েটা না করে উপায় ছিলো না।
এরপর বছর না ঘুরতেই সরকারি চাকরি পেয়ে গেলো নীরা, মহেশপুর গ্রাম্য এলাকায় পোস্টিং হলো। বিয়ের কাগজপত্র সব স্বামী রবিনের বাসায় রাখা ছিল অতি যত্নে। তখনও সংসার শুরু করেনি বা কাউকে জানায়ওনি, রবিন বেকার ছিলো বলে।
নীরার বাবাই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে মহেশপুর রেখে এলেন এবং নীরার যেখানে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিলো তার আসেপাশের বাসার সবাইকে তার একমাত্র মেয়ের খেয়াল রাখতে ও বলে এলেন। ভালো মতোই চাকরি করছিলো সেখানে। আর সেখানেই হয়েছিল দ্বিতীয় বিয়েটা।
তবে সেই বিয়ের স্মৃতি মনে করতে চায় না একদম নীরা, সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, মনে পড়লে এখনো গা শিউরে ওঠে। ঐ এলাকার লোকজন এতোটাই খেয়াল রেখেছিল যে, জোর করে বিয়েও দিয়ে দিয়েছিলো ওর, সেই সাথে বাবা-মাকেও ফোন করে অনেক আজে বাজে কথা ও শুনিয়েছিলো যেগুলো একদম মিথ্যে ছিলো।
সেসব শুনে তো নীরার বাবা মা নীরার উপর থেকে বিশ্বাসই হারিয়ে ফেলার অবস্থা। ছয়মাস পর আজ আবার অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তৃতীয় বিয়েটা হতে যাচ্ছে সবার উপস্থিতিতে।
সেসব কথা আর ভাবতে পারছেনা নীরা, দেরি হয়ে যাচ্ছে, বেরিয়ে পড়লো পার্লারের উদ্দেশ্যে বউ সাজতে।
পার্লার থেকে সেজেগুজে এসে চুপচাপ বসে আছে , একটা সময় কাজী এসে বিয়ে পড়ানো শুরু করলো আর তখন ই মনে পড়লো , বাড়ির বিয়েতে মেয়েরা সহজে কবুল বলে না ,তাই একটু সময় নিয়ে কান্নাকাটি করার চেষ্টা করে আস্তে ধীরে কবুল বললো। আসেপাশের সবাই যেভাবে কবুল কবুল বলছিলো তাতে নীরার বলা কবুল আদৌ কাজী সাহেব শুনেছেন কিনা তাতে সন্দেহ আছে। তবে এইবার বিয়েতে একদম অন্যরকম অনুভূতি হলো নীরার। বিয়ে আসলে সবাইকে নিয়ে আনন্দে করলেই মজা হয়।
এতো দিনের এতো কষ্ট আর চেষ্টা আজ সফল হলো। সম্পর্কের একটা সুন্দর স্বীকৃতি পেলো ভেবে নীরার ভীষণ ভালো লাগছে। বিয়ে তিনবার হলেও এই প্রথমবার শশুরবাড়ি যাচ্ছে নীরা।
ও বাড়িতে গিয়ে সাজানো বাসর ঘরে বসতেই নীরার এক এবং একমাত্র স্বামী রবিন এসে পাশে বসেই বলল—আমার মতো স্বামী আর পাবা না এই দুনিয়ায়। এক বউরে তিন তিনবার বিয়ে করলাম। মানুষ তিনবার বিয়ে করলে তিন রকমের তিনটা বউ পায় আর আমি এক বউই পাইলাম বারবার। হায়রে কপাল!
নীরা বলল— আর ও বিয়ে করার সখ আছে তোমার?
রবিন — না বাবা ! এখন থেকে কাগজ পত্র পকেটে নিয়ে ঘুরবো নাইলে দ্বিতীয় বিয়ের মতো আবার ও বিয়ে করা লাগতে পারে। মানুষের উপর বিশ্বাস নেই তো।
নীরা —সেই কথা মনে পড়লে এখনও ভয় লাগে মনে হয় যেন, মানুষ খুনের চেয়েও বড় কোন অপরাধ করেছিলাম। অথচ আমরা দুজনই বিবাহিত এবং প্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম। আমাদের কথা বিশ্বাসই করলো না কেউ?
রবিন— আর রিস্ক নেয়া যাবে না। তোমাকে আর বিয়ে করতে চাই না আমি। অনেক হয়েছে।
বিগত দুই বিয়ের স্মৃতি মনে করে রবিন আর নীরা দুজনেই হাসতে লাগলো। ঠিক বছর খানেক পর ওদের কোল জুড়ে জমজ ছেলে মেয়ে এলো। এখন আর কোন ভয় নেই।