স্বামী প্রভাষক। শিক্ষিত। তবুও কথায় কথায় নির্যাতন করত স্ত্রীকে। মেয়েটি নিম্নবিত্ত পরিবারের বলে যৌতুক, টাকা দাবি মেটাতে পারেনি। প্রভাষকের প্রথম দুই স্ত্রীও নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ডিভোর্স নিয়ে চলে যায়। আফরোজা ছিল তার তৃতীয় স্ত্রী। পুরো পরিবার মিলে বিভিন্ন অজুহাতে নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন করত আফরোজাকে। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে বলে তাকে নানা কথায় অপমান ও মারধর করা হত। এরমধ্যেই বেশ কয়েকবার তাকে মেরে গুরুতর আহত করে। সপ্তাহখানেক আগে আফরোজার বাড়িতে খবর পাঠানো হয় সে ‘নিখোঁজ’। অন্যদিকে এলাকায় প্রচার করে আফরোজা ‘পরকীয়া করে পালিয়ে গেছে’। পরকীয়াকে উল্লেখ করে আফরোজার নিখোঁজ সংবাদ প্রকাশ করতেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায় শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। অতঃপর ৬ দিন পর শ্বশুরবাড়ির উঠোন খুঁড়ে বের করা হল আফরোজার লাশ। লাশ উদ্ধারের পরপরই পালাল পুরো পরিবার।
ঘটনাটি ঘটেছে কক্সবাজারের মহেশখালীর কালারমারছড়া এলাকার উত্তর নলবিলা এলাকায়। একই এলাকার হাসান বশিরের ছেলে রাকিব হাসান বাপ্পি হল আফরোজার স্বামী। সে বদরখালী কলেজে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে কাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, এমন নির্যাতনের কারণে প্রভাষকের আগের দুই বউ তার সাথে ঘর করেনি। প্রভাষক বাপ্পির প্রথম ঘরে একটি কন্যা সন্তান আছে। নিম্নবিত্ত পরিবারের আফরোজারও আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। স্বামী মারা যাওয়ায় বাবার বাড়ি ফিরে আসে আফরোজা। এরপর আফরোজার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় রাকিব হাসান বাপ্পির সাথে। আফরোজা মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের পূঁইছড়া গ্রামের মো. ইসহাকের মেয়ে। বিয়ের পর থেকেই আফরোজাকে নির্যাতন করে বাপ্পি। ঘটনার জেরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাও দায়ের হয়েছে। কিছুদিন আগে আপস করে আফরোজাকে শ্বশুরবাড়ি ফিরিয়ে আনে স্বামী বাপ্পি। গত ১২ অক্টোবর বাপ্পির মা রোকেয়া হাসান পুত্রবধূ নিখোঁজ হয়েছে বলে আফরোজার বাবার বাড়িতে খবর দেয়। নিখোঁজের খবর পেয়ে আফরোজার পিতার পরিবার মহেশখালী থানায় রিপোর্ট করে। সেদিন থেকে আফরোজা ‘নিখোঁজ’ ছিল। আফরোজার পরিবার বিভিন্ন জায়গায় তাকে খুঁজতে শুরু করলে একপর্যায়ে স্বামী রাকিব হাসান বাপ্পি পালিয়ে যায়। বাপ্পি পালিয়ে যাওয়ার পর আফরোজার পরিবারের সন্দেহ হয়। রোববার (১৭ অক্টোবর) রাত ১১টায় এএসপি মহেশখালী সার্কেল ও মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আব্দুল হাই ঘটনাস্থলে গিয়ে উঠোনের মাটি খুঁড়ে আফরোজার লাশ উদ্ধার করেন।
আফরোজার মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আর মাইয়ারে বইডাত গারি ফেলাইয়ে (আমার মেয়েকে বসায় পুতে ফেলা হয়েছে)। গালর বুতর স্যান্ডল গলাই দিয়ে (মুখের মধ্যে সেন্ডেল ঢোকানো ছিল)। ধোয়াইবার সত দেকখিদে তলফেডত হালা দাগ ( লাশ গোসল দেওয়ার সময় দেখেছি তার তলপেটে লাথির দাগ)। ইতারা বেগগুনে মিলি আমার মাইয়ারে জেয়াতা গারি ফেলাইয়েদে (ওরা সবাই মিলে আমার মেয়েটাকে হয় জীবিতই পুতে ফেলেছে)।’
আফরোজার বোন বলেন, ‘মামলা করতে আমার ভাই ও বাবা গেছে। কিন্তু আমরা কতটুকু সহায়তা পাব জানি না। আমার বোনের হত্যার বিচার ঠেকাতে ওরা দলীয়ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের ক্ষমতা নেই। পুলিশ আমাদের খুব একটা সহায়তা করছে না। লাশ পোতার জায়গাটিতে আমাদের বেশিক্ষণ দেখতে দেয়নি। জানি না আমার বোনকে জীবিত অবস্থায়ই পুতেছিল কী না। ’
বাপ্পির বড়ির প্রতিবেশী এক নারী বলেন, ‘আফরোজার স্বামী ইয়াবার নেশা করে। তার আচরণ খুব ভয়ানক। আফরোজাকে অনেকবার মেরেছে। এসব নিয়ে কেউ কথা বলতে যায় না। ওরা মনে করে ওদের ঘরের বিষয়ে কেউ নাক গলাচ্ছে। তাকে এত বেশি মারত যে মাঝেমধ্যে মার সহ্য করতে না পেরে এখানে আমাদের বাড়ি পালিয়ে আসত। তাদের পুরো পরিবার প্রচণ্ড নির্যাতক প্রকৃতির। আফরোজার স্বামীর ভাই আরিফ হাসান স্থানীয় যুবলীগ নেতা। আরিফ ও আফরোজার শ্বশুর ‘আফরোজা পরকীয়া করে পালিয়ে গেছে’ এমনভাবে খবর প্রচার করে।
আফরোজাকে কখন খুন করা হয়েছে জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, ‘৬ দিন বা ৮দিন আগেও হতে পারে। আফরোজা নিখোঁজ এ খবর প্রচার করে তারা ১২ অক্টোবর। হতে পারে তার কয়েকদিন আগেই তাকে খুন করা হয়েছে। বাপ্পির প্রথম ঘরের মেয়েটি বলে দেওয়ায় আফরোজার লাশ উদ্ধার হয়েছে।’
মহেশখালীর একজন স্থানী সাংবাদিক বলেন, আফরোজা খুনের বিষয়টা তারা গোপন রাখতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল বাপ্পি ও তার পরিবার। সাংবাদিকদের একধরনের নির্দেশনাই দেওয়া হয়েছিল যে ‘পরকীয়া করে পালিয়ে গেছে’ এভাবে সংবাদ তৈরি করতে। লাশ বের হয়ে সব প্রকাশিত হয়ে পড়ায় তারা এখন চাইছে মামলা ম্যানিপুলেট করতে।
আফরোজা বেগমের বড়ভাই মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমার বোনকে খুব অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিলাম। প্রথম স্বামী মারা গেলে উত্তর নলবিলার হাসান বশিরের ছেলে রাকিব হাসান বাপ্পীর সাথে বিয়ে দিই। বাপ্পির এটা তৃতীয় বিয়ে। প্রথম স্ত্রীর ঘরে একটি কন্যাসন্তান আছে। তার বয়স ৫ বা ৬। বাপ্পির মেয়েটি বাপ্পির বাড়িতে থাকত। আমার বোনকেই মা বলে ডাকত। আমার বোন আফরোজা মেয়েটির দেখাশোনা করেছে। গরীব বলে তারা তাকে নানা কথা শোনাত। মারধর এসব নতুন নয়। মামলায় আপস করে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে সংসারে। এবার তারা আমার বোনকে মেরেই ফেলল। আধো আধো বোলে কথা বলা ছোট্ট মেয়েটিই আমাদের তথ্য দিয়েছে আমার বোনের লাশ পোতা আছে উঠানে।’
তিনি বলেন, ‘রাকিব হাসান বাপ্পীর মা রোকেয়া হাসান গত ১২ অক্টোবর বিকালে বাবাকে ফোন করে বলে আফরোজা নিখোঁজ হয়ে গেছে। এরপর অনেক খুঁজেও তার খোঁজ পাইনি আমরা। স্বামী হাসান বাপ্পি পালানোর পর আমাদের সন্দেহ বাড়ে। মহেশখালী থানা পুলিশকে মৌখিকভাবে জানাই। কালারমারছড়া ফাঁড়ির দায়িত্বশীল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি। পরে মহেশখালী থানার ওসির পরামর্শে বুধবার থানায় একটি নিখোঁজ ডায়রি করেন আমার বাবা মো.ইসহাক।’
আফরোজার ভাই আরও বলেন, আমার বোনকে খুনের পর তারা উল্টো আমাদেরই দোষ দিচ্ছিল যে আমাদের মেয়ে পরকয়িা করে চলে গেছে। প্রথমে তারা চেয়েছে সেটাই প্রচার করতে। এখন লাশ উদ্ধার হওয়ার পর তারা চাইছে মামলায় যেন পুরো পরিবারের কথা না আসে। শুধু বাপ্পিকেই আসামি করা হয়। পালিয়ে গিয়ে তাদের পরিবার আমার বোনের খুনের ঘটনা লুকাতে বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। আমি জানি না, এর বিচার হবে কী না!
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) আবদুল হাই বলেন, ‘লাশ উদ্ধার করেছি। ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পুরো বিষয় তদন্ত করে পরবর্তী আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবং ঘাতককে খুঁজে বের করা হবে।’