‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ আন্দোলনে শরীক হতে গিয়ে উল্টো সাইবার মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে নারীদের। পাকিস্তানি অভিনেতা আলী জাফরের বিরুদ্ধে ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ যৌন হয়রানির কথা মিশা শফি নিজের টুইটার হ্যন্ডলে প্রকাশ করার পর আট নারীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছেন বলিউডি নায়ক আলী জাফর। ভুক্তভোগী ওই আট নারীও সেলিব্রেটি। পাকিস্তানে হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনের ভাগ্য ঝুলে আছে এ মামলাটির উপরই।
পাকিস্তানে আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল এপ্রিল ২০১৮ তে। দ্য রিল্যাক্ট্যান্ট ফান্ডামেন্টালিস্টখ্যাত অভিনেত্রী ও গায়িকা মীশা শফি নিজের টুইটার হ্যন্ডলে প্রকাশ করেছিলেন তিনি অভিনেতা আলী জাফরের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তাও একাধিবার।
মিশা শফি লিখেছিলেন, কথা বলার মাধ্যমে আমি আমাদের সমাজে যে নীরবতার সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে তা ভেঙে ফেলার আশা করছি।
এরপরই মিশা শফির বিরুদ্ধে সাইবার মানহানির অভিযোগ তুলে মামলা দায়ের করেছেন আলী জাফর। একে একে ওই মামলায় যুক্ত করা হয়েছে ৮ নারীকে। ফেসবুক টুইটারে ওই বিষয়টিতে জাফরের বিপক্ষে যাওয়া নারীদের এমনকী সংবাদপত্রে নিবন্ধ লেখা নারীদেরও মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।
সম্প্রতি ওই মামলায় বিবাদি করা হয়েছে লীনা ঘানিকে। লীনা হলেন পাকিস্তানের একজন শিল্পী ও অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি নির্যাতনের শিকার নারীদের সাহায্য করেন। লীনা ঘানি জানান, যৌন নিপীড়কের বিরুদ্ধে কথা বলে তিনি মামলা হয়রানির শিকার হয়েছেন। লীনা ঘানি একা নন। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে আরও সাতজনের নাম। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখে আলী জাফরের দায়ের করা মামলায় বিবাদি হয়েছেন।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানি আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ দ্য গার্ডিয়ানকে জানায়, লীনা ঘানি এবং অন্যদের বিচারের জন্য তাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। অভিযুক্ত অভিনেতা জাফর জানান, মিশা শফি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যে টুইট করেছিলেন। আমার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তিনি প্রমাণ করতে পারেননি। সুতরাং তার অভিযোগকে আমি খারিজ করি। জাফর নিজেকে সমর্থন করতে বারেবারে স্ত্রীকে নিয়ে টেলিভিশন শোতে হাজির হতেন ও অশ্রু ঝরিয়ে তিনি তার বিরুদ্ধে সব অপপ্রচার হচ্ছে বলে অভিযোগ করতেন।
যৌন হয়রানির ওই অভিযোগগুলো পাকিস্তানের গভীর রক্ষণশীল ইসলামী সমাজে বারবার সমালোচিত হয়েছে। যেখানে নারীদের চুপ করিয়ে রাখা সংস্কৃতি সেখানে নারীরা কথা বলছেন। এ যেন এক ধৃষ্টতা! তার উপর ক্ষমতাধর পুরুষ সেলিব্রেটি জাফরের জনপ্রিয়তার কারণে নারীদের উপর অবিশ্বাস যেন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে। তবে জাফরের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগে সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্তত ডজনখানেক নারী মিতা শফির সমর্থনে পথে নেমেছেন।
মিশা শফির পর জাফরের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ হাজির করেছিলেন ব্লগার হুমনা রাজা। আরও তিনজন নারী অভিযোগ করেছেন যে, জাফর সামাজিক নেটওয়ার্কে “পরোক্ষ হয়রানি” করেছিলেন।
হাসিম উজ জামান নামের এক সাংবাদিক এমন টুইট করেছিলেন যে, ‘ আলী জাফর নারীদের হয়রানি করে’। ঐ এক টুইটে জাফর তাকে ক্ষমা চাইতে জানিয়ে আইনি নোটিশ দেয়। যদিও তিনি স্পষ্টতই ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেছেন। হাসিম উজ জামান বলেন, ক্ষমা চাওয়া মানে কেবল আমার সাংবাদিকতার ক্ষতি নয় বরং ভবিষ্যতে আরও নারীদের অত্যাচারের মুখে ফেলে দেওয়া। এই অপরাধবোধ নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না।
মিশা শফির আইনজীবী নিঘাট বাবা বলেছেন, ‘আমি কয়েক ডজন নারীদে চিনি যারা প্রমাণশ যৌন হয়রানির অভিযোগ করলেও বিনিময়ে পেয়েছেন, আইনি হয়রানি, ভিডিও ভাইরালের হুমকি, প্রাণনাশের হুমকি। ওই নারীরা জানান পাকিস্তানি সিস্টেমে নারীর জন্য কোন পথ নেই।’
নিঘাট বাবা আরও বলেন, ‘সাইবার ক্রাইম’ মামলার ব্যবস্থা হয়েছিল নারীদের সুরক্ষা দিতে। এখন সেটি ব্যবহার হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, এমনটাই বারবার ঘটতে দেখছি। কোন মেয়ে অভিযোগ করলে তাকে মানহানি মামলায় ফাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। তারপর সব শান্ত হয়ে যায়।
অন্যদিকে আলী জাফরের আইনজীবী আমব্রিন কুরেশি এসব অভিযোগ সম্পর্কে কথা বলতে নারাজ। তবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এফআইএর কাছে প্রমাণ পেশ করেছি যার কারণে শফিসহ আরও আটজনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান। কুরেশি বলেছেন, শফি তার অভিযোগ সমর্থন করার জন্য কোনও সাক্ষী দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে শফির আইনজীবীরা বলছেন তাকে সুযোগই দেওয়া হয়নি।
কোরেশি জানান, আদালতের নথিগুলি এখন পর্যন্ত দেখাচ্ছে যে, নিরীহ সব মানুষকে একদল মহিলা অপরাধমূলকভাবে প্রচারণার লক্ষ্যবস্তু করছে।
এমন অভিযোগের মুখোমুখি আটজন নারী জানান, তারা তাদের বিরুদ্ধে এমন বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারকে অস্বীকার করে এবং বলে যে তারা আদালতে মামলাটি লড়তে চায়। তারা সাইবার মানহানি আইন বাতিল চান।
লিনা ঘানি বলেছেন, ‘লোক এখন বলছে যে হ্যাশট্যাগমিটু পাকিস্তানে এসে মুখ থুবড়ে মারা যাচ্ছে। এটি এতটাই ভয়াবহ যে নারীরা হয়রানির শিকার, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হলেও তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা সবাই বুঝি পারি যে পাকিস্তানের হ্যাশট্যাগমিটু আন্দোলনের জয় এই মামলার সাথে জড়িত।’
লিনা ঘানি আরও বলেন, ‘পুরো ব্যবস্থাই আমাদের নারীদের বিপক্ষে। আলী জাফর একজন ক্ষমতাধর মানুষ। তবে মিথ্যা বলা ও সে মিথ্যে নিয়ে বাঁচার বদলে বরং কারাগারেই চলে যাই।’