পেন্সিল স্কেচে পারমিতা সরকারের আঁকা কয়েকটি ছবি একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে পুরুষতন্ত্র ও ভোগবাদিতা কীভাবে পরস্পরকে আঁকড়ে রেখেছে। সেখানে পণ্য ছাড়া কিছুর মূল্য নেই। জীবন একটা পণ্য স্বপ্নও একটি পণ্য। তিনি তার আঁকা ছবিতে দেখালেন নারী পুরুষের লিঙ্গ বৈষম্য ও তাদের আচরণও ভোগবাদী সমাজ এঁকে রেখেছে। তার এক চুল বাইরে যাবার সাধ্য কারও নেই।
পরিমিতা বলেন, ‘একটি লিপস্টিকের বিজ্ঞাপন আপনাকে বোঝাবে এটি ছাড়া আপনার জীবন একেবারেই অসম্পূর্ণ। টকটকে লিপস্টিক আঁকবে আপনার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বকে। ধর্ষণের খবরে দেখবেন রেপ শব্দটির উপর যতটা জোর দেওয়া হয় ‘স্টপ’ শব্দটি ঠিক ততটাই ম্লান। একদিকে আলো ঝলমলে এ নগরে বিক্রি হয়ে যায় কত শরীর অন্যদিকে অন্ধকার গলিতে ধর্ষিতার আর্তনাদে কাঁপে আকাশ। পত্রিকায় চলে তার ধর্ষণের রগরগে কাহিনী। লোভী চোখে সেসব পড়ে যায় ভবিষ্যত ধর্ষকেরা। এ যেন অদৃশ্য কানুন, হয় বিকিয়ে যাও নয়ত কিনে নাও!’
পারমিতার কথায়— আমাকে ঠিক নারীবাদী বলা যায় না। কিন্তু নারীর পণ্যায়নে পুরুষতন্ত্রের কালো হাত শিল্পী হিসেবে আমার চোখ এড়ায় না। এ জাল ভয়ংকর। আপনাকে প্রথমে একটি পণ্য চেনাবে। তারপর তার উপযোগে এ আপনাকে অভ্যস্ত করে তুলবে। এরপর তারচেয়েও ভালো পণ্য বাজারে আসবে। এক সময় শুনতে না চাইলেও তারা আপনাকে কাপড় খুলে দেখাবে। স্বাধীনতার ঝাণ্ডা উড়িয়ে পুরুষ প্রধান এ নগ্ন সমাজ আপনাকে নারীর নগ্নতা বিক্রি করবে।
‘সাবলীল দেহ সৌষ্ঠব এখানে একটি পণ্য। তার মান আছে আছে নির্দিষ্ট মাপও। সেসব পেতে আপনি অর্থ খরচ করবেন অনর্থে। আপনার বিলাসিতা এঁকে দেবে শ্রেণি বৈষম্যের আরেক্টা ফুটস্টেপ। নারীর শরীর এখানে শুধুই এক্টা টোপ।’— যোগ করেন তিনি।
পারমিতা বলেন, ‘সভ্যতা অনেক প্রাচীনকাল থেকে পুরুষতান্ত্রিক। তার সাথে উনিশ শতকে যোগ হয়েছে পুঁজিবাদ। বর্তমান যুগকে বলা যায় পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদের যুগ। বিংশ শতাব্দীর সবকিছুই প্রোডাক্ট। বস্তুনির্রভর এ সভ্যতা মানুষের স্বপ্নেরও সীমানা এঁকে দিচ্ছে।’
‘এ পণ্যায়নের যুগে পুরুষত্বের চিহ্ন হল অর্থ, মারপিট, সাহস, পৌরুষ ও শক্তি। সাহসিকতা শুধু পুরুষেরই অলংকার। অন্যদিকে নারীর সৌন্দর্য্যর সংজ্ঞায় পণ্য বানানো হয়েছে তার শরীরকে। তাই কখনো আমার মনে হয় পুঁজিবাদ ও ভোগবাদ পুরুষ দ্বারাই প্রভাবিত।’
‘তাই আমার আলেখ্য চিত্রে দেখাতে চেয়েছি পণ্যের বিলবোর্ডের আলোয় উদ্ভাসিত আলেয়া আর হাইহিলের উচ্চতা আসলে একই। এ পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। মধ্যবিত্তের সে আকাশ ছুঁতে পাড়ি দিতে হয় শ্রেণি বৈষম্যের বিশাল এক দেওয়াল। নিন্মবিত্তের সেখানে কোন স্থানই নেই। নিম্নবিত্ত হল ভোগবাদিতার চক্ষুশূল।’
পারমিতা বলেন, ‘উনিশ শতকে এ ব্যাপারে জানা যায় এট্রাক্টিং দ্য আফফ্লুএন্ট বইতে। ওতে বলা হয়—ব্যবসায় সংগঠনগুলো বুঝতে শুরু করলো ধনী ক্রেতারাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় লক্ষ্য। আর তাই উপরের শ্রেণির রুচি, জীবনাচরণ, আর পছন্দই বিষয়টাই একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম ধনীরা তাই এমন কিছু কিনতে বাধ্য হল যেটি তাদের সামাজিক পর্যায়কে নির্দেশ করবে। (Attracting the Affluent। Naperville, Illinois: Financial Sourcebooks,1990) । আমার ছবিটির বিষয় বস্তু ভোগবাদীর ওই আগ্রাসনকে নির্দেশ করে। যে আগ্রাসন ধীরে ধীরে আমাদের ভোগবাদ ও বৈষম্যবাদ থেকে নিয়ে গেছে শরীরের নিখুঁত রুপায়নে।’
তিনি বলেন, ‘বিদ্যালয় জীবন থেকেই আমি পড়ালেখার পাশাপাশি আঁকাআঁকিরও ক্লাস করতাম। ফুলকি, শিশু একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমি আমার শিল্প শিক্ষার ভিত্তি নির্মাণ করে। শিল্পের নানা ধারায় নিজেকে যাচাই করেছি। শেষে আমার আঁকার প্রতি আগ্রহটাই লক্ষ্যণীয় ছিল। এ ব্যাপারটা আমার মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না। তিনি আমাকে সবসময় নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে দিতেন চিত্রকলা চর্চার জন্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তির সময় ও তিনি নির্দ্বিধায় আমাকে সাপোর্ট করেছেন।
‘এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরা আমার চিন্তার পরিধিকে প্রসারিত করেন। ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে চিত্র চর্চা শুরু করি। আমার নিজের কাজ কখনোই আমার প্রদর্শনযোগ্য মনে হয়না। একদম শেষ দাগটি আাঁকার পরও সন্তুষ্টি আসে না। কোন একদিন একটি কাজ করে অন্তত নিজেকে শিল্পী বলার মত প্রশান্তিটুকু চাই।’
পারমিতা সরকারের শৈশব কেটেছে চট্টগ্রাম জামালখানে। সেখানেই প্রাথমিক আর মাধ্যমিক পড়াশোনা সেন্ট মেরীস ও ড.খাস্তগীর স্কুলে। এরপর কলেজ এ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিকে পড়ার পর চারকলায় স্নাতক শেষ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।