Margaret T. Singer, উনি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার সাইকোলজির একজন প্রফেসর। তিনি সুদীর্ঘ সময় কাল্ট (cult) সাইকোলজি নিয়ে কাজ করেছেন। কাল্ট বলতে সহজ অনুবাদ কি হবে বাংলায়, বুঝতে পারছি না। ইংরেজিতে এর সংজ্ঞা টা এরকম
1. A system of religious veneration and devotion direct towards a particular figure or object.
3. A person or thing that is popular or fashionable among a particular group or section of society.
বলতে গেলে “পীরতন্ত্র” শব্দটা বললে বুঝতে বেশি সুবিধা হয়। “দেবত্ব আরোপ” এটাও ব্যবহার করা যায়, কিন্তু কঠিন হয়ে যায়।
কাল্ট সাইকোলজিটা এমন ইন্টারেস্টিং যে, অনেক ব্যক্তি নিজেই জানেন না যে তিনি একটা কাল্টের অংশ।অন্ধের মতো, বা নিজের অজান্তেই তিনি “পীরের মুরিদ” হয়ে যান। যেই ব্যক্তি তাকে ঘিরে বা কোন দলের নেতা হয়ে কাল্ট কালচার চর্চা করে, তাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটু জানার এবং বোঝার বিষয় আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়ার সময়, আমাদের একটা কোর্স ছিলো ক্রিমিনোলজি। তো ক্রিমিনোলজি পড়তে গিয়ে, আমার আগ্রহ ঝুঁকে যায় ভিক্টিমোলজি, সাইকোলজি এই সাবজেক্টগুলোর প্রতি। আমার সাধ্য থাকলে আমি এই সাবজেক্টগুলোর উপর অনার্স পড়তাম, মাস্টার্স করতাম পিএইচডিও করতাম।
কিন্তু আমি অতো ব্রিলিয়ান্ট কেউ নই, তাছাড়া আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন মানুষ, আমার বাবা শিল্পপতি নন, দেশের বাইরে গিয়ে পড়বো? কেন যেন তেমন কোন স্বপ্ন আমার ছিলো না। আমি সাধারণ, সাদামাটা একজন। তাই শুধু আইনেই অনার্স, মাস্টার্স করে, বার কাউন্সিলে পরীক্ষা দিয়ে আইনজীবী হয়েছি। হাইকোর্টের আইনজীবী হওয়ার জন্য অপেক্ষমান।
যাই হোক।
তো সাইকোলজি ক্রিমিনোলজি নিয়ে টুকটাক পড়ালেখা করি । সেই সব পড়তে গিয়েই এই কাল্ট কালচার বা কাল্ট সাইকোলজি সম্পর্কে জানা।
সাইকলজির আবার আরও একটি শাখা হচ্ছে, সাইকোপ্যাথোলজি। Joe Navarro M.A একজন এক্স এফ বি আই (FBI) এজেন্ট, যিনি আমেরিকায় প্রায় ২৫ বছর কাজ করেছেন, ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডিভিশন্স বিহেভিয়ারেল এনালাইসিস প্রোগ্রামে। তিনি এছাড়া আরো নানান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির শিক্ষার্থীদেরও পড়ান। তো কাল্ট লিডারদের সম্পর্কে তার লেখা একটা আর্টিকেল আছে, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, কাল্ট লিডারদের একটা কমন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা “প্যাথলজিক্যাল নার্সিসিস্ট” ।
সাইকোপ্যাথলজিতে নানান ডিজঅর্ডার নিয়ে আলোচনা আছে। ডিজঅর্ডার থাকা একজন মানুষের অপরাধ না, কিন্তু বিষয় হচ্ছে, এরকম ডিজঅর্ডার যদি কারো থাকে, তাহলে তার ট্রিটমেন্ট দরকার, যেন তার নিজের এবং তার দ্বারা আশেপাশের মানুষের কোন ক্ষতি না হয়। অন্যের ক্ষতি না হলেই হলো, নইলে বাদবাকি, মানুষ তার আপন রঙ্গে বাঁচুক কোন সমস্যা নেই।
আরেকজন কাল্ট রিসার্চার এবং লেখক, Janja Lalich,PhD, উনি সোশিওলজির প্রফেসর ক্যালিফোর্নিয়া স্টেইট ইউনিভার্সিটির, তিনি এই কাল্ট সাইকোলজি নিয়ে বলেছেন, এটা পাওয়ার ইমব্যালেন্স এর খেলা। যিনি কাল্ট লিডার, তিনি তার আশে পাশের মানুষদের তার ফ্যান ফলোয়ার বানিয়ে রাখে, বা মনে করে। কখনো সেইম লেভেলের ভাবে না। বন্ধু বলে, কিন্তু নানান সময়ে আচরণে, কথায় বুঝিয়ে দেয় যে, সেই বন্ধুর অবস্থান তার নিচে। ফলে যারা তাকে বন্ধু ভেবে কাছে এসেছিলো, তারা আহত হয়।
একজন কাল্ট লিডার, এর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে তার আশেপাশের মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিভাবে?
তার ফলোয়াররা যেন তার পরবর্তী চাল কি হবে, সে কখন কিভাবে প্রতিক্রিয়া করবে, কোথায় গিয়ে কি আচরণ করবে এটা যেন বুঝতে না পারে। এটা হতে পারে সারপ্রাইজ দেয়া, হতে পারে এমন কোন বিপদে ফেলে দেয়া যেটাতে পড়ে মানুষ হিমশিম খাবে, বা হতে পারে, বা এমন একটা আচরণ করা যার জন্য মানুষ আগে থেকে প্রস্তুত নয়। অনেকেই এটাকে “পাগলামি” নাম দিয়ে হাস্যরসের মাধ্যমে এটাকে দেখে। অনেকের কাছে ভালো লাগে, তাদেরও পাগলামি করতে ইচ্ছে হয়। যাদের ইচ্ছে হয়, তারা সেই কাল্টের ফ্যান ফলোয়ার হয়ে যান।
কারণ, যখন ফলোয়াররা জানে না তার পরবর্তী স্টেপ কি হবে, তখন তারা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
Joe Navarro M.A. তার শিক্ষার্থীদের জন্য কোন কাল্ট বেশি বিপজ্জনক সেটা চিহ্নিত করতে কতগুলো পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করেন।
কয়েকটা তুলে ধরছি।
১। তিনি ব্যপক পরিমাণে মানুষকে বিশ্বাস করাবেন যে তিনি খুবই স্পেশাল একজন মানুষ।
২। যে কোন সমস্যায় একমাত্র তার কাছেই উত্তর আছে।
৩। তিনি পুরোপুরি বিশ্বস্ততা দাবি করবেন।
৪। নিজেকে অতিমূল্যায়ন করবেন এবং অন্যকে অবমূল্যায়ন করবেন।
৫। কোন সমালোচনা সহ্য করবেন না।
৬। তাকে কেউ প্রশ্ন করুক, কেউ চ্যালেঞ্জ করুক এটা সে সহ্য করতে পারবে না।
৭। একটা অনন্য চার্মিং পার্সোনালিটি থাকবে।
৮। তার একটা নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা থাকবে যে সে কী এবং কতকিছু অর্জন করতে পারে।
৯। একটা অসীম লেভেলের ব্রিলিয়ান্ট, ক্ষমতা, সাফল্যের কল্পনা দ্বারা সে নিজেকে ঘিরে রাখবে।
১০। প্রশ্নাতীত ভাবে অন্ধ সমর্থন প্রত্যাশা করবে।
১১। সকলের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার আকাংখ্যা রাখবে, এবং সে জন্য সে যা যা করলে প্রশংসা পেতে পারে , সেগুলোই করবে।
১২। যৌনতা তার জন্য একটা বিষয়।
১৩। পাবলিকলি মানুষকে অবমূল্যায়ন করবে, যেন সেই মানুষ নিজেকে ছোট মনে করে।
১৪। তার ফ্যান ফলোয়ার্সদের ত্রুটি স্বীকার করানোর জন্য, তাদের নিয়ে হাস্যরস করবে, হিউমিলিয়েট করবে, তাদের কোন গোপন তথ্য বা দুর্বলতা থাকলে সেটা ফাঁস করার হুমকি দিবে বা ফাঁস করবে।
১৫। সব সময় দেখা যাবে তার কাছে যা আছে, তা সবচেয়ে বেস্ট। তার লাইফ, তার চিন্তা, তার চলা বলা , জীবন যাপন সবচেয়ে বেস্ট।
১৬। অন্যের মনোযোগ পাওয়ার জন্য নিজেকে যেভাবে অন্যের দৃষ্টি কাড়লে রাখা যায়, সেভাবে রাখবে। ধরুন, যে মাথার চুল ফেলে দিলো, বা চুলের রঙ এমন করলো যে অদ্ভুত লাগে দেখতে, যেমন অপু ভাই। শাড়ির সাথে বুট জুতা পড়লো। মানে এমন একটা গেট আপে তাকে দেখা যেতে পারে, যেটা দেখলে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ তাকে নোটিস করবে।
১৭। তার সাথে যোগাযোগ অনেকটা এক তরফা। যখন তার প্রয়োজন হবে, বা ইচ্ছে করবে সে নিজে এসে যোগাযোগ করবে, নচেত তাকে সহজে পাওয়া যাবে না।
১৮। তার কাছাকাছি আসতে পারা, তার ফ্যান ফলোয়ারদের জন্য একটা পুরষ্কারের মতো ব্যপার।
১৯। হিংস্রতা, আচরণে আগ্রাসী মনোভাব, আবার অতি দয়ালু মনোভাব, আবেগী আচরণ সবকিছুই তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে থাকবে যা দিয়ে আরেকজন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
২০। সমালোচনা করা হলে তিনি শুধু ক্রোধ দেখাবেন না, ক্রোধের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
২১। ব্যক্তিগত লাভের জন্য মানুষকে এমন ভাবে ম্যানুপুলেট করবে এবং ব্যবহার করবে, যেন তারা মানুষ নয় বস্তু।
২২। নিজেকে এমন ভাবে মাঝে মাঝে অন্যের সামনে তুলে ধরবে যে মানুষ তাকে সত্যিই সে কে, বুঝতে পারবে না। এই বুঝতে না পারার মাধ্যমেই সে অন্যকে কন্ট্রোল করতে পারে।
২৩। অভ্যাসগত ভাবেই অন্যকে ছোট করে দেখবে, শুধু সেই শ্রেষ্ঠ।
২৪। সব সময় এই খেয়াল বা চিন্তা করবে যে, কে তাকে সমর্থন করছে এবং কে তার বিরোধীতা করছে। এবং সেই অনুযায়ী মানুষদের চিহ্নিত করবে।
২৫। নিজের দোষ কখনোই স্বীকার করবে না, এবং নিজের দোষের জন্য কখনোই ক্ষমা চাইবে না।
২৬। “আমি” শব্দটি তার কথোপকথনের মধ্যে আলোচনায় আধিপত্য বিস্তার করে, এবং তার এটাও খেয়াল থাকে না যে সে কতবার আমি আমি করছে।
২৭। নিজেকে অপ্রতিরোধ্য মনে করবে এবং সেরকম ঘোষণা দিবে, দিতে থাকবে।
Dan Neuharth , PhD, আরেকজন সাইকোথেরাপিস্ট যিনি এমন আরও ১৪ টি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করেছেন।
কিন্তু এদের থেকে নিজেকে বাঁচাতে , তিনি একটি কৌশল দিয়েছেন, যা হলো, তার কাছে ব্যক্তিগত বা কোন তথ্য শেয়ার না করা, কারণ পরবর্তীতে সেই তথ্য তিনি আহত করার জন্য, বা নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। আর একজন কাল্ট লিডার, তার ফ্যান ফলোয়ারদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, তাদের গোপন তথ্য পাবলিকলি ফাঁস করে দেয়।
লেখক- আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী