পুরুষ দিবস নেই কেন, বাসের আলাদা সিট কেন, মানবতাবাদ না হয়ে নারীবাদ কেন?—নারীদিবস এলেই ফেসবুকের হোমপেজে যেসব অবান্তর প্রশ্নের ছড়াছড়ি দেখা যায় তার কিছুর সংক্ষিপ্ত উত্তর কয়েক বছর ধরে নিজের ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করি।
পুরুষ দিবস নেই কেন?
আছে। ১৯ নভেম্বর পুরুষ দিবস, যার খোঁজ আপনি নিজেও রাখেন না কারণ এই দিবসের প্রয়োজনীয়তা আপনি বোধ করেন না। আমিও করি না, কারণ পুরুষের অধিকার নিয়ে আলাদাভাবে কোনো সমস্যা নেই। একজন পুরুষ হিসেবে আপনার যেসব সমস্যা বা দাবি রয়েছে সেগুলোর আলোচনা অন্যান্য ব্যানারের আওতায় হচ্ছে বলেই আপনি এতোটা বেখবর।
আপনারা চাইছেন নারীর সমান অধিকার, তাহলে বাসে নারীর জন্য আলাদা সিট কেন থাকবে?
শুধু বাসে আলাদা সিটই নয়, আরো অনেক ক্ষেত্রে নারী বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। এটাকে বলে জেন্ডার কোটা। ঠিক যেমন আছে আদিবাসী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা। কোটা কেন থাকে? সুবিধাবঞ্চিত অনগ্রসর মানুষকে সামনে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করার জন্য। খেয়াল করে দেখুন শুধুমাত্র লোকাল বাসেই নারীর জন্য আলাদা সিট থাকে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে মেয়েদের জন্য দৈনন্দিন ব্যবহারের পরিবহন ব্যবস্থাকে কিছুটা নিরাপদ করা। যেসব মেয়েরা বাসে পুরুষের স্পর্শের ভয়ে বের হতে চায় না, বাসের আলাদা সিট তাদেরকে একা চলাচলে উৎসাহিত করবে। বের হতে হতে এক সময় তারা সাহসী হয়ে উঠবে, তাদের প্রতি পুরুষের আচরণও হয়ত পরিবর্তিত হবে। তখন আর আলাদা সিটের প্রয়োজন হবে না। দুরপাল্লার বাসে, ট্রেনে বা প্লেনে তো নারীর জন্য আলাদা সিট থাকে না। এর কারণ কী? যেসব মেয়েদের গতিবিধি এসব পরিবহণ ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট বিস্তৃত হয়েছে তারা বিভিন্ন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারঙ্গম হয়ে উঠেছেন বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে।
ধরুন, একটা মেয়ের মাসিক ঋতুস্রাব চলছে, সে ব্যথায় কাতরাচ্ছে, বাসে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সে কি আরাম করে বসে থাকা কোনো পুরুষকে বলতে পারবে- ‘ভাই মাসিক ঋতুস্রাবের কারণে আমার ভীষণ ব্যথা হচ্ছে। আপনি কি উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে একটু বসতে দেবেন?’ সেই অবস্থানে কি আমরা পৌঁছুতে পেরেছি? কখনো পারব? এই দৃষ্টিতে দেখলে লোকাল বাসগুলোতে নারীর জন্য কয়েকটা আলাদা সিটের প্রয়োজন সবসময়ই থাকবে। কারণ নারী পেটে সন্তান ধারণ করে যা পুরুষ করে না, নারীর ঋতুস্রাব হয় যা পুরুষের হয় না। এই প্রাকৃতিক ভিন্নতার জন্য আপনি নারীকে ঘরে বসে থাকার পরামর্শ দেবেন? নাকি বাইরের জগতকে তার জন্য নিরাপদ করে তুলবেন? কোনটা এই পৃথিবীর জন্য বেশি লাভজনক? ভেবে দেখুন।
নারীবাদ নয়, মানবতাবাদ প্রয়োজন
শোনেন, মানবতাবাদের আন্দোলন ‘আদম-হাওয়ার’ যুগ থেকে হয়ে আসছে তবু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বৈষম্য আজো দূর হয়নি। কেন জানেন? কারণ হচ্ছে ক্ষমতাধর মানুষরা চিরদিন নিজেদেরকে একটু বেশি মানুষ বলে ভেবে এসেছে এবং অন্যদের উঠে আসার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। অতীতে ইংরেজদের সমতাবাদের আন্দোলন থেকে ভূ্মিহীন সাদাদেরকে বাদ রাখা হতো, কারণ তাদেরকে যথেষ্ট মানুষ ভাবা হতো না। কালোদেরকে বাদ রাখা হতো, দাসদেরকে বাদ রাখা হতো, নারীদেরকে বাদ রাখা হতো কারণ এরা কেউই যথেষ্ট মানুষ ছিল না, আজো নয়। আজো যখন আপনি মানবতার কথা বলছেন সেই ভাবনায় আপনার বাসার সাহায্যকারী ছেলে বা মেয়েটির স্থান কিন্তু নেই। সে আপনার চেয়ে একটু কম মানুষ। তার প্রতি মানবিকতার অর্থ হলো তাকে আপনার মত একই খাবার দেবেন, অসুখে চিকিৎসা দেবেন, কিন্তু আপনার মত একই অবস্থানে যেতে হলে তার যেসব সাপোর্ট প্রয়োজন সেগুলো কিছুতেই দেবেন না। সে হুবহু আপনার মত একটা পোশাক পরে ফেললে সেটা নিয়ে রাগ না হোক, হাসাহাসি আপনি অবশ্যই করবেন।
এই একই মনোভাব নিজের অজান্তেই আপনি নারীর প্রতিও পোষণ করেন। আপনার বাসার সাহায্যকারীর মতই আপনার স্ত্রীর প্রতিও আপনি যথেষ্ট মানবিক কিন্তু সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে আপনার সমান অবস্থানে তার উঠে আসার জন্য যে সাপোর্ট প্রয়োজন সেটা আপনি কিছুতেই তাকে দেবেন না। সেটা নিশ্চিত করাই হচ্ছে নারীবাদের কাজ। নারীবাদ আপনার স্ত্রীকে আপনার প্রভু বানাতে চায় না, বরং আপনাকে প্রভুত্বের সিংহাসন থেকে নামিয়ে তার সঙ্গী বানাতে চায়।
নারী দিবস একদিন কেন, প্রতিদিন নয় কেন?
একটা দিবস পালনের অর্থ এই নয় যে ঐ একদিনই শুধু সংশ্লিষ্ট বিশ্বাস ধারণ করা হবে। বরং দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা সারা বছর এই বিষয়ে একেবারেই নিরুদ্বেগ থাকেন তাদেরকে ঝাঁকুনি দিয়ে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা, ভাবতে উৎসাহিত করা যাতে বছরের বাকি দিনগুলোতেও তারা এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে এবং সক্রিয় হতে পারেন। আপনার ব্যস্ত জীবনে হয়ত প্রতিদিন মায়ের খোঁজ নিতে পারেন না কিন্তু মা দিবসে তাকে একগোছা ফুল অথবা উপহার দিয়ে ঠিকই জানিয়ে দেন যে তিনি আপনার কাছে কতটা মূল্যবান। মা দিবসের পরদিনই সেই মূল্য হারিয়ে যায় না। মা দিবস, ভালোবাসা দিবস, গোলাপ দিবস, চকলেট দিবসের প্রয়োজন হয়ত নেই, কিন্তু নারী দিবসের প্রয়োজন আছে কারণ পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠি নারীর উপর অকথ্য নির্যাতন চলছে এখনো যা সমস্ত মানবজাতির জন্যই ক্ষতিকর। অর্ধেক জনগোষ্ঠী খারাপ থাকলে, অধিকার বঞ্চিত থাকলে মানুষের সার্বিক মঙ্গল কীভাবে সম্ভব?
নারীই তো নারীর শত্রু, তাহলে এসব দিবস করে লাভ কী?
যে ননদ-ভাবী, শ্বাশুড়ি-বৌ সম্পর্কগুলো দেখে আপনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তার পেছনের কাহিনি নিয়ে আপনি বোধ হয় খুব একটা ভাবেননি। পুরুষের স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাই নারীকে পুরষতান্ত্রিক মনোভাব দিয়ে গড়ে তুলে অন্য নারীর পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। বিলিয়ার্ড বা স্নুকার খেলার কথা যদি ভাবেন তাহলেই বিষয়টা বুঝতে পারবেন। খেলোয়াড় মানুষটি একটা লাঠি দিয়ে সাদা বলকে আঘাত করে, সাদা বলটি অন্য রং এর বলকে আঘাত করে। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে বলগুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে, অথচ মূল হোতা হচ্ছে লাঠি হাতে একজন খেলোয়াড়। রঙ্গিন বলটি বাড়ি খেয়ে গর্তে ঢোকার সময় হয়ত খেলোয়াড়কে দেখে না। কিন্তু আপনি আমি- পর্যবেক্ষকরাও কেন পুরুষতন্ত্র নামক খেলোয়াড়টিকে দেখতে পাচ্ছি না?
আরেকটা কথা, নারীর মূল বিচরণক্ষেত্র সংসারের দুই ফুট জায়গার ভেতরে সামান্য ক্ষমতা নিয়ে যেমন নারী পরস্পরের সাথে শত্রুতায় লিপ্ত হয়, ঠিক তেমনটা কি পুরুষের বিচরণক্ষেত্রেও ঘটে না? রাজায় রাজায় কি যুদ্ধ হয় না? বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অবস্থান নিয়ে কি পুরুষদের মধ্যে শত্রুতামূলক আচরণ দেখা যায় না? ক্ষমতার লড়াই একটা সহজাত বিষয় যা নারীপুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই খাটে। কর্মক্ষেত্রে এই লড়াইটা আবার নারীদের মধ্যে ততটা দেখা যায় না। আমি খেয়াল করে দেখেছি, সংসারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসা নারীরা পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত সাপোর্টিভ যা আপনাদের এই অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণিত করে।
নারীরা পার্লারে গিয়ে, ফেসিয়াল করে, সেজেগুজে নিজেদের পণ্য বানিয়ে তুলছে—নারী দিবস করে কোন আমড়াটা হবে তাহলে?
কথাগুলো আংশিকভাবে সত্য। আসলেই নারীরা কিছুটা হলেও এসব করছে। কিন্তু এর কারণটা কী? এসব নারীরা বড় হয়েছে এই সমাজেই, ছোট থেকেই তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে দেখতে সুন্দর না হলে বিয়ে হবে না। যে সমাজে কালো মেয়ের বিয়ে হয় না, আবার বিয়েই মেয়েদের জীবিকার একমাত্র নিশ্চয়তা, কুড়িতেই যে সমাজে নারীকে বুড়ি ধরা হয়, সে সমাজে ইনসিকিউরিটির অনুভূতি থেকে মেয়েরা এসব করবে সেটাই স্বাভাবিক। নারীদের দিকে আংগুল তোলার আগে ভেবে দেখুন নিজের ব্যক্তিত্ব বা চিন্তাভাবনা বিকাশের কতটুকু সুযোগ নারীরা পায়, বা কতদিন ধরে পাচ্ছে? আপনারা হয়তো দু’চারটা উদাহরণ এনে দাঁড় করাবেন যেক্ষেত্রে শিক্ষিত, সুযোগ পাওয়া মেয়েরাও নিজেদেরকে পণ্যের মত উপস্থাপন করছে, কিন্তু বিষয়টা হাজার বছরের কন্ডিশনিং এর, একটা প্রতিষ্ঠিত ট্রেন্ডের। এক্ষেত্রে এককভাবে একজন নারীকে অপবাদ দেয়াটা নায্য হয় না। কয়েক শত বছর ধরে স্বাভাবিক জীবন বাঁচার সুযোগ পেলে নারী এসব সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে পারবে অবশ্যই।
আমি সমস্ত মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার থাকা উচিৎ। নারী, পুরুষের মধ্যে যেমন প্রাকৃতিক কিছু পার্থক্য রয়েছে, তেমনি প্রকৃতিগত ভাবে সাদা আর কালো মানুষদের মধ্যেও রয়েছে। সভ্য কোনো মানুষ বিভিন্ন জাতির মানুষদের মধ্যে আরোপিত কোনো বিভেদ কে স্বীকার করে না। অথচ নারী এবং পুরুষের মধ্যকার আরোপিত, বিশেষ করে অধিকার সংক্রান্ত, বিভেদ্গুলোকে মানুষ কী অবলীলায় লালন করে চলেছে, ভাবতে অবাক লাগে। আমাদের সমাজে এর মাত্রা অনেক বেশি। এইসব বিভেদ দূর না করতে পারলে একটা সুন্দর সমতাভিত্তিক সমাজ কিছুতেই গড়া সম্ভব নয়। আর এজন্যই আমি বলব মানবতার খাতিরেই নারীবাদ এবং নারীদিবসের প্রয়োজন রয়েছে।