প্রিয় মুন্নি সাহা। শুভেচ্ছা নিবেন। আপনার লাস্ট টকশো নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেজে নানাজনের ক্ষুব্ধ বক্তব্য দেখলাম। সে থেকেই মনে হলো, বিষয়টা নিয়ে আপনাকে কিছু লিখি।
ই-ভ্যালিকে নিয়ে যেহেতু বিতর্ক ও তদন্ত চলছে তাই তাকে নিয়ে কি বলছেন সেটাতে আমার আগ্রহ নেই।
আমার প্রশ্ন হলো টক শোতে ই-কমার্স ব্যাবসাকে কেন ‘হাওয়ার ব্যাবসা’ বলে অভিহিত করলেন? ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যাবসা কি শুনতে একটু বেশি ভালো শোনাত। সেজন্যে ‘হাওয়ার ব্যাবসা’ বলে চটকদারি নাম দিয়ে একটু কটাক্ষ করলেন কি?
তাহলে শুনুন, এই লকডাউনে হু হু করে অনলাইন ব্যাবসা বেড়ে যাওয়ার কারণ কি কখনো খেয়াল করেছেন?
লকডাউনে বেকার সংখ্যা বেড়ে গেছে, কিংবা মাসের পর মাস শুধু ঘরে বসে না থেকে কিছু একটা করার চিন্তা থেকেই অনেকেই অনলাইন ব্যাবসায় ঝুঁকেছেন।
আপনি বা আপনার রাষ্ট্র, বিগত দিনের বেকার সংখ্যা কমাতে কি কি উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলবেন?
কি কি কর্মসংস্থান তৈরি করেছিলেন?
তাহলে বোঝার উপর শাকের আঁটির মত এই যে হুট করে চাকরি চলে যাওয়ার দরুণ বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া লোকগুলো, এই যে শহরময় টুলেট ঝুলতে থাকা আর গ্রামে ফিরে যাওয়া বেকার যুবকেরা, এদের জন্যে কি কিছু করা সম্ভব?
শুনলাম একদিনেই ৮০ জন সংবাদকর্মী ছাঁটাই হয়েছে। আপনি বা আপনার প্রতিষ্ঠান, তাদের কোনো চাকরি বা অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা দিতে পেরেছেন কি?
এখন সেই মানুষটি যদি আরেকটি চাকরি পাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক দূর্দশা কাটিয়ে উঠতে ব্যাবসার চিন্তা করেন, তাহলে এই করোনার সময়ে বাইরে না গিয়ে তিনি কিরকম ব্যাবসা করতে পারেন যাতে করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে অন্তত কিছুদিন খেয়ে পরে চলতে পারেন? নিশ্চয়ই অনলাইন ব্যাবসা? অর্থাত আপনার কথায়, ‘হাওয়ার ব্যাবসা’, তাই তো?
আপনার সরকার বা আপনারা এই ‘হাওয়ার ব্যাবসা’ টিকে থাকার জন্য এমন কি উদ্যোগ নিয়েছেন বলবেন কি? উদ্যোক্তা লোনের যে গল্প আমরা শুনি সেটা এই উদ্যোক্তাদের ৫% ও পায় কিনা খোঁজ নিয়েছেন? আর বাকি ৯৫% কিভাবে তাদের ব্যাবসা চালাচ্ছে জানতে চেয়েছেন? জ্বী, উদ্যোক্তা বলেই হয়ত সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে, নিজেদের পয়সায়, নিজেদেরই পরিচিত মহলে তারা ব্যাবসা করে যাচ্ছে। অথচ সেই ব্যাবসা থেকে উইদাউট এনি কো-অপারেশন, সরকার ট্যাক্স কেটে নিতে কিন্তু দ্বিধা করছে না। ‘হাওয়ার ব্যাবসা’ থেকেও ট্যাক্স, ভাবুন তো!
পাটশিল্পটাকে তো খেয়ে দিয়েছে জানেনই। তাঁতশিল্প যে ধুঁকছিল, তাঁতীরা যে তাঁত বেচে দিয়ে নতুন ব্যাবসায় যাচ্ছিল, এসব খবরও নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। অথচ এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কল্যাণে আজ অনলাইন সয়লাব দেশি তাঁতে, দেশি পণ্যে। বলতে পারেন দেশি পণ্যের খড়কুটো যেন এই ই-কমার্স আই মিন ‘হাওয়ার ব্যাবসা’, যেটা ধরে নিজেদের আজ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে সকল দেশিয় শিল্প।
যে ক্রেতাগোষ্ঠীকে আজীবন ইন্ডিয়ান শাড়ি কামিজ থেকে ফেরাতে পারেননি, তারপর পাকিস্তানি থ্রি পিস আর লোন (সুতো) কাপড়ে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন, সেই ক্রেতাগোষ্ঠি আজ জামদানি কিনছে অনলাইনে, তাঁতের শাড়ি-জামায় তাদের আগ্রহ বাড়ছে। পয়লা বৈশাখের বিশাল বাজার এখন সম্পূর্ণ দখলে দেশি পণ্যের, এমনকি পাশের দেশ ভারতেও। দেশের টাকা দেশেই থাকছে, বেঁচে যাচ্ছে তাঁতীরা আর তাঁত শিল্প। আপনাদের ভরসায় থাকলে পাটের মত জামদানিও বিলুপ্ত হতে সময় লাগত না কিন্তু!
দেশি মধু, দেশি তেল, ঘানির সরিষা, ঢেঁকিছাঁটা চাল, বিন্নি চালের ভাত, প্রায় বিলুপ্ত এইসব একশভাগ দেশি পণ্যগুলো আবার তাদের সুদিন ফিরে পেয়েছে ইকমার্সের মাধ্যমেই। অনলাইন পেইজগুলো ঘুরে দেখুন, নিজেও জানেন না এমন সব দেশি পণ্যের বাজার যেন একেকটা পেইজ আর গ্রুপ। এমন একটি দেশিয় পণ্যের বিপ্লব ঘটে গেল সবার অগোচরে শুধুমাত্র এই ই-কমার্সের কল্যাণেই। আর আপনি বলছেন কিনা ‘হাওয়ার ব্যাবসা’!
শুধু এই ই-কমার্সকে ভিত্তি করে কি পরিমাণ কর্মসংস্থান হয়েছে সেটা খেয়াল করেছেন কি?
শুধু পণ্য উৎপাদনকারীই নয়, পণ্য বিপনণকারীদের মধ্যেও নতুন নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে শুধু ইকমার্সকে ঘিরে। এই লকডাউনে কত বেকার শুধু অনলাইন ডেলিভারি করে জীবিকার সন্ধান পেয়েছে সেই হিসেবটা একটু দেখুন। রাষ্ট্র যাদের কোনো দায়িত্বই নিতে আগ্রহী নয়। ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান, ডেলিভারি সংরক্ষণ, ডেলিভারী ম্যান পর্যন্ত যে হাজার হাজার কর্মসংস্থান হলো তার জন্যে অন্তত এই ‘হাওয়ার ব্যাবসা’ কে একটু অভিনন্দন জানাবেন না?
এই উদ্যোক্তাদের একটা পণ্য তৈরি থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত , কত অসংখ্য মানুষের জীবিকা যুক্ত থাকে দয়া করে একদিন গবেষণা করুন আপনার টীম নিয়ে। হয়ত সারপ্রাইজড হবেন! যেসব ফিজিক্যাল ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে সেগুলোও এখন ধুঁকে ধুঁকে টেকার একটা সম্ভাবনা দেখছে এই অনলাইন বিজনেসে।
অনলাইন বিজনেসটা শুধুমাত্র কম দামে পণ্য এনে বেশি দামে বেচার প্ল্যাটফর্ম না, এটা একটি বিশাল সেক্টর, যেখানে অসংখ্যরকম জীবিকার সন্ধান পাওয়া যায়। আর যার মাধ্যমে সরকার এবং দেশের জনগণ, দুইই উপকৃত হচ্ছে। তানাহলে এই সেক্টরের সাথে যুক্ত মানুষগুলোর দায় নিতে সরকারকে হিমশিম খেতে হতো কিনা ভাবুন।
সবশেষে ভাবুন, এই যে আপনি, মাসের তিরিশটা দিন বাইরে না বেরিয়ে নিজের চাকরি বাঁচাচ্ছেন, অথচ শপিংটাও ভালো লাগে বোরিংনেস কাটাতে, সেক্ষেত্রে ই-কমার্স আপনাকে সেই সুযোগটা দিচ্ছে কী না? আপনার বাজারটা চলে যাচ্ছে বাসায়, আপনার শাড়ি আর সেইসাথে ম্যাচিং দুল চুড়ি চলে আসছে যথাযথ ঠিকানায়, আপনার দুপুরের রুচি বদলানো হোম মেইড ডিশটা ঠিক সময়ে আপনার অফিসের টেবিলে, আর আপনি এসি রুমে বসে শুধু অঙ্গুলি হেলনে আপনার চাকরি বাঁচিয়ে শপিং শেষ করে ফেললেন মুহূর্তেই। এটাই তো ‘হাওয়ার ব্যাবসা’, নাকি? আপনার এই সামান্য শপিং এ কতগুলো মানুষের জীবিকা নির্ভর করেছিল, শপিং শেষে যদি খোঁজ নিতেন!
ভাগ্যিস, আলিবাবা, আমাজনকে সেই দেশে কেউ ‘হাওয়ার ব্যাবসা’ বলে না বরং সম্মানের চোখে দেখে। আর সে কারণেই হয়ত আজ আমাজন, আলীবাবার জয়জয়কার। শুকরিয়া যে ঐসব দেশে একজন ‘মুন্নি সাহা’ নেই!
বিনীত অনুরোধ, এই ‘হাওয়ার ব্যাবসার’ নেপথ্যে যে বিশাল জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের অবসান কিংবা দেশীয় শিল্পের বিলুপ্তি থেকে বেঁচে ওঠার গল্প, কখনো সম্ভব হলে আপনার টকশোতে সম্মানজনকভাবে তুলে ধরবেন।