ফারহানা আজিম একজন প্রকৃতিপ্রেমী। তাকে নগর কৃষকও বলা চলে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। পরিবারের জন্য চাকরি ছেড়ে এসে শহুরে জীবনকে সতেজ করতে সবুজের চাষ শুরু করলেন। ফারহানার ছাদবাগানে সবুজ গাছ যেন আকাশ ছুঁয়ে যায়। এ যেন তার নিজের এক জগৎ! কয়েকবছরেই তার ছাদবাগানে উৎপাদিত হল নানারকম শাক-সবজি, ফুল-ফলসহ প্রায় একশো রকমের গাছ।
চট্টগ্রামের মুরাদপুরের বিবিরহাটে অবস্থিত নিজেদের নয়তলা ভবনের ছাদটিই যেন তার কৃষিভূমি। নিজ পরিবারের সবজির চাহিদা পূরণ হয় তার ছাদবাগান থেকেই। বাগানের একপাশে বাহারি ফুলের গাছ তার পাশেই বসার ব্যবস্থা করে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছেন নিজের ছাদবাগানকে।
বাগানকাজে তার অসাধারণ পারদর্শিতার প্রশ্নে তিনি অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন চট্টগ্রামের একটি ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ ‘চট্টগ্রাম বাগান পরিবার’ এর কথা। ফারহানা আজিমের মতে, ‘ঘরে থাকি বা বাইরে, আমি ঘরের নারী বা বাইরের নারী, যেখানেরই হই সৃষ্টিশীলতা বা কিছু করার জন্য নিজের চিন্তার জগৎটা যেন থেমে না যায়! নিজের সপ্নের জগৎটা যেনো থেমে না যায়!’
নগরকৃষক ফারহানা আজিম বলেন, ‘আমার মনে হয়, সবুজ অবারিত সেই প্রান্তর আমাদের মাঝে এক মানবিকতা ও সংবেদনশীলতা তৈরি করেছে তবে এখনকার বাচ্চারা সেখান থেকে অনেক দূরে। যান্ত্রিক নির্ভরশীলতার জীবনে ওই অনুভূতিটা ওরা পাচ্ছে না। সন্তানদের জন্য সে ভাবনা থেকেই বাগান করা। এ ইট পাথরের শহরে যদি আমার বাচ্চাদের সবুজের ছোঁয়া দিতে পারি তাহলে মন্দ কি?’
তিনি আরও বলেন, ‘ এমন চিন্তাভাবনা থেকেই আমি আমার বাগানটা ছাদে নিয়ে আসি। বাচ্চারা ছাদে মাটি, কাদাঁ, পানি নিয়ে খেলে । সেখানে মাটির কাছে ,কাদাঁর কাছে থেকেও অনেককিছু শিখতে পারে। ওরা ছাদে এসে খেলে ,সাইক্লিং করে, নিজেদের সৃজনশীলতার মাধ্যমে বাগানকে আরও সাজিয়ে তুলে। ওরা দেওয়ালে নানারকমের ছবি, ছোট-ছোট স্কেচ করেছে। বাগান করার ক্ষেত্রে বাচ্চাদের আনন্দে মিশে থাকা সৃজনশীলতা আর সবুজের সাথে যে মিশ্রণটা দিতে পেরেছি ওখানেই আমার সার্থকতা।’
ফারহানা জানান তার বাগানে আছে ৫৭ রকমের গোলাপ, আছে প্রায় ১৫-২০ ধরনের জবা,কাটামুকুট, অলকানন্দা, চন্দ্রপ্রভা, লেডিং হার্ট। ফুলের মধ্যে বাগানবিলাস ভালোবাসেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বাগানবিলাস খুব সুন্দর করে ফুটে একেবারে চারদিক ভরপুর করে রাখে। তেমন যত্ন লাগে না।
সবজি চাষ সম্পর্কে ফারহানা বলেন, মৌসুমি সবজি আমি ছাদবাগানেই ফলাই। শীতে টমেটো,বাধাঁকপি,লাউ,কুমড়ো ,বেগুন,পুষ্টিকর শাক। ঋতুভিত্তিক প্রায় সকল সবজির চাষ করি ছাদে।
বাগান করা কীভাবে শিখেছেন জানতে চাইলে ফারজানা আজিম উইম্যান ভয়েস বিডিকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আম্মুকে দেখেছি বাগান করতে। সারাজীবনই তিনি গাছপালা নিয়ে সবুজ নিয়ে থেকেছেন । এটি আম্মুর কাছ থেকেই সহজাতভাবে পাওয়া । আসলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত নগর জীবনের পর একটু পর যখন থিতু হলাম তখন মনে হলো আবার সেই পুরনো শখ , নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সে জায়গা থেকেই আবার বাগান শুরু করলাম।’’
তিনি বলেন, প্রতিটা ঋতুর সাথে সাথেই আমার বাগানটা পরিবর্তন হয় । কিছু ঋতুভিত্তিক গাছ আছে কিছু স্থায়ী । আমার প্রথম পছন্দের তালিকায় আছে গোলাপ । গোলাপ যেমন ভালোবাসার ফুল ঠিক তেমনি সে প্রচুর পরিচর্যা চায়,প্রচুর সময় দিতে হয় ।
জীবন ভাবনা নিয়ে ফারহানা আজিম বলেছেন, ‘আমি কর্মজীবী জীবন এবং আমার জীবন নিয়ে বলবো । আমি দুটোই দেখেছি। ইউএনএইচসিআরে দায়িত্ব পালন করেছি দীর্ঘ নয় বছর। এখন চাকরি ছেড়ে হোমমেকার। দুটো জীবনই দেখেছি আমি। আমার এ জীবনকে আমি গৃহিণী জীবন বলি না, বলি আমার জীবন। কর্মজীবনে আজ এ দেশে কাল ও দেশে, ট্রেনিং, ওয়ার্কশপের ওই দিনগুলো আমার কাছে অমলিন থাকবে।’
তিনি বলেন, বিয়ে হয়েছিল ২০০৭ এ। বরের কর্মস্থল চট্টগ্রাম নগর এবং আমার কক্সবাজার। প্রথম সন্তান জন্মের পর মনে হয়েছে আমার জন্য ও আমার বাচ্চার জন্য আমি আরেকটা জীবন দেখতে চাই। সেটা হল এই পারিবারিক জীবন। কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই আমি চাকরিটা ছাড়লামি এরপর এ নিয়ে কোন আফসোস নেই আমার। এবং চাকরীটা ছাড়ার পর আমার কোনরকম আফসোস হয়নি। চাকরি ছাড়া জীবন বৃথা এভাবেও ভাবিনি আমি। আমি কাজ করতে জানি। নিজেকে ভালো রাখতে জানি।
তিনি বলেন, নিজের প্রতি আস্থা আর আত্মবিশ্বাসটাই আমার কাছে জীবন। আমি ঠিক জানি, আমি কি করবো , কোথায় হ্যাঁ বলবো কোথায় না ,আমার পছন্দ- অপছন্দ। ঘরের নারী বা বাইরের নারী নয় নিজের চিন্তার জগৎটা যেনো না থামে স্বপ্নের জগৎটা যেন না থামে। তখন চারপাশটাকে ভালো লাগে।
বাগান করার কাজকে বাণিজ্যিকভাবে নিতে চান কী না প্রশ্ন করলে ফারহানা আজিম বলেন, আমি তো সবুজ ও একটু বিশুদ্ধ অক্সিজেনের জন্য বাগান করেছিলাম। শাকসবজিতে এখন পরিবারের চাহিদা মিটছে। একসময় হয়ত বাণিজ্যিকভাবেও ভাবব। এটা ভেবেই ভাল লাগে আমাকে দেখে কেউ অনুপ্রাণিত হচ্ছে। একজনকে দেখে অন্যজন করছে তাও বা কম কী?