কখনও ঝরা পাতার মুকুল, মনি পরি, রোকসানা আক্তার আরজু আবার কখনওবা বা নিপা আক্তার ও অরিন্দম নীল ফেসবুকের এই আইডিগুলো ব্যবহার করে নারীর নামে কুৎসা রটানো ও অশ্লীল ছবি প্রকাশ করে ব্ল্যাকমেইল করে ওরা। আইডি হ্যাক করে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিয়ে সেগুলো প্রকাশ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রাঙামাটির চার সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেছেন রাঙামাটির ১৯ বছর বয়সী এক ভুক্তভোগী নারী রুমা (ছদ্মনাম)। রোববার (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর অধীনে ২৩, ২৪,২৫,২৯ ও ৩৪ ধারায় মামলাটি রাঙামাটির কোতয়ালী থানায় এফআইআর হিসেবে রেকর্ড হয়েছে। এ মামলায় এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
অভিযুক্ত দুই সংবাদকর্মী হলেন, জাহেদা বেগম (৪০), মোহাম্মদ আলমগীর মানিক (৩৮)। অন্য দুই অভিযুক্তরা হলেন মাসুদ পারভেজ নির্জন (২৪), শহীদুল ইসলাম হৃদয় (২৫)।
‘আমার হ্যাকিং জগতে কেউ মাফ নেই’, ‘আমি ড্যাম শিউর আমার কাছে ওর ৫০+ ছবি আছে’, ‘আপনি রাতে ঘুম যেতে পারবেন না। আমার স্ট্রকের (স্টকের) জিনিস খুব মূল্যবান। আপনার বউকে বলেন কোন স্পেশালিস্টের কাছে সিকিউরিটি স্ট্রং করতে। কারণ আমার যা কালেকশন করার তা করা হয়ে গেছে। কোন আইডিতে টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন থাকলে কিভাবে হ্যাক করতে হয় জানেন? আপনি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা যোগ করেন দেখি তবুও আটকিয়ে রাখতে পারেন কিনা। সেটা রাঙামাটির যেই হোক না কেন সে যদি ফেসবুক, জিমেল ব্যবহার করে তার সবকিছু আয়ত্তে আনা তুরির (তুড়ির) ব্যাপার।’
ফেসবুকের মেসেনজারে এমন হুমকি এসেছিল জানিয়ে ভিকটিম নারী রুমা বলেন, ‘ফেসবুকের ফেইক আইডি থেকে যা হুমকি এসেছে ঠিক তাই করেছে ওরা। আমার আইডি হ্যাক করে আমার ব্যক্তিগত ছবি ছড়িয়ে দিয়ে আমার সম্পর্কে অনেক অশ্লীল কথা ছড়ায় ওরা। শুরুতে আমার স্বামী জিডি করেছিলেন তবুও ওরা থামেনি। বারবার একই কাজ করে যাচ্ছে ও আমাদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই রাঙামাটির কোতয়ালী থানায় সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছি। সংবাদকর্মী হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে ওরা এলাকায় অনেক মানুষের ব্যক্তিগত ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে নানা স্বার্থ সিদ্ধি করে এবং অনেকের ভিডিও ছড়িয়ে দিয়েছেও।’
ভিকটিম নারী রুমা বলেন, ‘জাহেদা বেগম ও আলমগীর মানিকসহ এলাকায় একটা সংঘবদ্ধ দল আছে যারা নারীসহ বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়। ওরা এলাকায় অনেক মানুষের সাথে ইতিমধ্যেই এমন করেছে। আমাকে ও আমার স্বামীকে পাহাড়ি সন্ত্রাসী দিয়ে অপহরণ করে হত্যার হুমকি দিয়েছে। আমার শ্লীলতাহানি করা হবে এমন কথাও বলেছে অনেকবার। আমার স্বামীর সাথে দ্বন্দ্বের কারণে আমার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে তারা। প্রথমে হুমকি দেয় তারপরেই আমার ছবি ছড়িয়ে যায় অনলাইনে। এতে আমার সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে ও আমার ব্যক্তিজীবন বিষিয়ে তুলেছে তারা।’
রুমা আরও বলেন, ‘মামলা দায়ের করতে আমাকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সংবাদকর্মী হিসেবে প্রশাসনেও ছিল তাদের অপরিসীম প্রভাব। অভিযোগ নিয়ে আমি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। এমনকি মামলা দায়েরের পর আমি বাদি হওয়া সত্ত্বেও তদন্তকারী অফিসার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা না নিয়ে উল্টো আমার ফোন জব্দ করতে চেয়েছিলেন। আমার ওই তদন্ত অফিসারের উপর আস্থা নেই। আমি অনতিবিলম্বে আসামিদের গ্রেপ্তার দাবি করছি।’
এ অভিযোগের প্রসঙ্গে রাঙামাটির কোতয়ালী থানার তদন্তকারী অফিসার (সাব ইন্সপেক্টর) নয়ন কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘বাদির অভিযোগটি সত্য নয়। আমি মোবাইল চেয়েছিলাম ভিকটিম নারীর আইডির নিরাপত্তা দিতে তবে জব্দ করতে চাইনি। মামলাটি তদন্তের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।’
মামলায় অভিযুক্ত জাহেদা বেগমকে ফোন করা হলে তিনি উইম্যান ভয়েস বিডির প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার বক্তব্য নিবেন? আমি এখন খেতে বসেছি একঘণ্টা অপেক্ষা করুন।’ একঘণ্টা পর তাকে পুনরায় কল করা হলে তিনি লাইন কেটে দেন।
এ বিষয়ে মামলায় অভিযুক্ত আলমগীর মানিককে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘এটি আসলে রাঙামাটি প্রেস ক্লাব নিয়ে দ্বন্দ্ব ও পারিবারিক বিষয়। আমি কাউকে ফেসবুকে হয়রানি করিনি। এ বিষয়ে আমিও মামলা দায়ের করেছি আদালতে। কেউ যদি ফেক আইডি দিয়ে আক্রান্ত হয় তাহলে ওই আইডিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করবে আমার নামে কেন করা হয়েছে?’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটির কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার (ওসি) মোহাম্মদ কবির হোসেন বলেন, ভিকটিম নারীর অভিযোগ পাওয়ার পর এফআইআর রেকর্ড করেছি। মামলাটি এখন তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।
ভিকটিম নারীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট আয়েশা সোনিয়া বলেন, ’১৯ বছর বয়সী মেয়েটি কলেজছাত্রী। সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে যখন আমার কাছে আইনি সহায়তা ও পরামর্শ নিতে আসে আমি তখন উপলব্ধি করেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করার পর বাংলাদেশে এর সুফল যেমন পাচ্ছে তথাপি এর অপব্যবহার ও অপরাধ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এই অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। এটা দেশের সমাজ ব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত। যারা এসব ঘৃণিত অপরাধের সাথে জড়িত তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একজন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে এটাই আমার এই প্রত্যাশা।’
উইম্যানভয়েস/এফএ