গোধূলি লাগা অশোকবনে একা বসে আছে সীতা। বাহিরে ঝনঝন করে বাজছে পৌরুষের গগনবিদারী আর্তনাদ। প্যারিস কে পরাজিত করে দ্রৌপদীকে জিতে নেবে মেনেলিউসের সৈন্যদল।
বিজিতের পুষ্পশোভিত রথে চড়ে তাকে ফিরতে হবে নিজের সংসারে।
নিজের? কার? কে সে? জনকনন্দিনী, পাঞ্চালী, মৈথিলী, সকলের আরাধ্যা দেবী নাকি কেবলই এক সামান্য অবলা?
যার জন্ম অমীমাংসিত। কিংবা লুকিয়ে রাখা হয়েছে পুরুষের বীরত্ব রচনার স্বার্থে।
কখনো তার জন্ম দেয়া হয় দেবতার ঔরসে, কখনো আগুন থেকে কখনো বা লাঙলের আঘাতে মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠে হেলেন!
অযোনিজ! মাতৃহীন!
স্বামীর বীরগাথা লিখতে হলে প্রথমেই নারীর নিজের জন্মপরিচয় বিশেষত মায়ের পরিচয় মুছে ফেলতে হয়! এটাই নিয়ম।
I am the daughter of Earth and Water,
And the nursling of the Sky;
I pass through the pores of the ocean and shores;
I change, but I cannot die.
For after the rain when with never a stain
The pavilion of Heaven is bare,
And the winds and sunbeams with their convex gleams
Build up the blue dome of air,
I silently laugh at my own cenotaph,
And out of the caverns of rain,
Like a child from the womb, like a ghost from the tomb,
I arise and unbuild it again.
অথচ অশোক বনে একা বসে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী হেলেন যখন আকাশ–পাতাল ভাবছিল, তখন দূতসভায় শ্বশুর, ভাশুরের বাজারে, পাঁচ পাঁচখানা স্বামীর চোখের সামনে দুর্যোধনের উদ্ধত ঊরুরবীভৎস আহ্বান তার মনে পড়ল না।
হেলেনের শুধু মনে পড়লস্বয়ম্বর সভার সেই দিন! ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে ওঠা অর্জুনের শরীর! সেই তীক্ষ্ণ চোখের সামনে সীতা যেন টের পেল তার নারীত্বের আস্বাদ! এই তবে প্রেম?
অর্জুন তাকে ফিরিয়ে দেয়নি। অর্জুন চেয়েছিল তাকে। মনে হয়েছিল এই চাওয়ার থেকে বড় কোনো প্রাপ্তি জীবনে নেই। জীবনের কাছে আর কোনো চাওয়া নেই দ্রৌপদীর।
কিন্তু না! চাওয়া ছিল। ইতিহাস থেকে যতই তার জন্মপরিচয় মুছে ফেলা হোক, যতই পুরুষের কল্পনার তুলিতে শুরু হোক তার জীবনকথা…. পুরুষের মতো, নারীর মতো, পৃথিবীর মাটি কণায় মিশে থাকা তারই মতো অজ্ঞাতকুলশীল প্রাণের মতো তারও চোখ ছিল, মন ছিল, চেতনা ছিল!
তাই আজ যখন একা, সমাজ, সংসার সমস্ত কাল্পনিক পরিচয় খুলে রেখে যখন এই সন্ধ্যার নীল আলোয় একা নিজের মুখোমুখি বসে আছে হেলেন…. তখন দুঃশাসনের নারীবিদ্বেষ নয়, তার মনে পড়ল….
পাণ্ডব পুত্রের অধর্ম। তার শরীরকে, মনকে, সত্তাকে, প্রেমকে মালিকানাধীন সম্পত্তির মতো পাঁচ ভাগে ভাগ করে নেওয়ার অন্যায়!
প্রেমে অন্ধ হলেও সেদিন চোখ খুলেছিল তার। কৃষ্ণকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি অর্জুনকে ভালোবাসি। আমি অর্জুনে সমর্পিত। এখন তার মায়ের কথা রাখতে তার আরও চার ভাইকে পতিরূপে বরণ করা কী অধর্ম হবে না? মিথ্যাচার হবে না। আমার মা তো এ কথা শেখায় নি।
সীতা ভুলে গেছিল তার মাতৃপরিচয় মুছে ফেলা হয়েছে। তার ধর্ম-অধর্ম জ্ঞান থাকতে নেই। পুরুষের মুখনিঃসৃত বাণীই তার ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ। আর কৃষ্ণও পুরুষ!
পত্নী ধর্মে কোনো খুঁত ছিল না তার। স্বামীর শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে দূতসভায় অন্যায়ের কাছে কাপুরুষের মতো মাথা নিচু করে বসে থাকা পাঁচ ভাইকে বন্দীত্ব থেকে উদ্ধার করেছিল হেলেন!
তত দিনে তার বোধ হয়েছে, পুরুষ রাজ্যজয়ের মতোই তাকেও জিতে নিতে চায় সম্পত্তি হিসেবে। তাই পুরুষের প্রয়োজনে তাকে অধর্ম করতে হবে। পুরুষের প্রয়োজন মতো তার প্রেমকে প্রসারণ এবং সংকোচন করতে হবে। পুরুষের ইতিহাসের স্বার্থে তাকে পিতৃহত্যা করতে হবে, মাতৃহীন হতে হবে এমনকি সর্বধর্মচারীনীতিবান পুরুষ যখন তার ওপর অন্যায় করবে তখন তাকে অযোধ্যার রাজধর্ম বলে মেনে নিয়ে চুপচাপ আগুনের ওপর হেঁটে যেতে হবে হাসিমুখে।
গর্ভ যে ধারণ করে না, জন্মের ধারণা যার নাই সেই তো মানুষকে আগুন থেকে জন্ম দিতে পারে। আগুনের ওপর হাঁটাতে পারে মানুষকে। মানুষকে। মানুষকে। মানুষকে।
মানুষ। শব্দটা বারবার বলতে থাকল সীতা! অশোক বনের নির্জনতায় প্রতিফলিত হতে থাকল জন্মরহিত, মাতাপিতাহীন, কল্পনারচিত এক নারীর স্তিমিত উচ্চারণ!
মানুষ!
মানুষকে ভালোবাসার জন্য মহান পুরুষ যত স্তবক রচনা করেছে তার কোথাও কী নারীর কথা লেখা নেই?
নারীকে ভালোবাসতে গেলেই কেন বারবার তাদের মনে পড়ে মাতৃআজ্ঞা! প্রজাধর্ম! রাজধর্ম!
কেন অযোধ্যার লোকের সন্দেহের সামনে দাঁড়িয়ে অর্জুন বলতে পারে না হেলেন আমার স্ত্রী। আমি তাকে ভালোবাসি। তোমাদের মন রাখতে আমি তার মন ভাঙতে পারি না।
রামের বনবাসে সঙ্গিনী হতে সীতার একবারও ভাবতে হয়নি। তার ভালোবাসা তাকে নির্দেশ দিয়েছিল তার কর্তব্যের। অথচ গর্ভবতী সীতাকে রাম কীভাবে একা দুঃসহ জঙ্গলে ফেলে আসতে পারল! কীভাবে পারলপ্রজাধর্মের অজুহাতে প্রেমিকার হাত ছেড়ে দিতে! কই সে তো একবারও বলল না, তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব, তোমার যা শাস্তি আমারও তাই, তোমার যা ভাগ্য আমিও তাই বরণ করব! সঙ্গী হওয়ার ভার কেবলই নারীর?
প্রতারক! প্রবঞ্চক! প্রজাধর্ম শেখাতে এসেছে! হৃদয়হীন পাষাণের মতো, কাপুরুষের মতো মিথ্যা কথা বলে কৃষ্ণাকে ছোট ভাইয়ের হাতে ছেড়ে দিল বনে ফেলে আসতে!
আমার হৃদয় তোমার ভার
তোমার হৃদয়ও তোমার ভার
অথচ এই রামের বীরত্ব রচনার জন্য দ্রৌপদী হাসিমুখে নিজের পিতা রাবণকে হত্যার ছক রচনা করতে দ্বিধা করে নি!
পুরুষ এমুন তয়?
একবার পাইবার পর, নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর?
রাজ্যজয় হয়ে গেলে ভাঙা কুলোর মতো নারী পড়ে থাকে এক কোণে। একা অশোক বনে। জীবনের রানওয়েতে একা। কোনো এক প্রেমের স্মৃতি নিয়ে, নিজের প্রেম নিয়ে, অপমানে, অভিমানে নিভৃতচারী তার মানুষ হৃদয়, হৃদয়ের সমস্ত ভার নিয়ে মাটিগর্ভে সমাহিত হয় দ্রৌপদী কিংবা হেলেন কিংবা সীতা।
আদেলোর সন্তানদের আঁকড়ে ধরে ক্লেয়া যেমন সারিয়ে তলে তার ক্ষত! একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে ফিরে আসে তাদের পুরুষহীন ঘরে।
নিজেদের একাকিত্ব ভাগ করে নেয়। কিংবা হঠাৎ বুঝে ওঠে পুরুষের বীরত্বগাথা বারবার লিখতে হয় কারণ কাপুরুষ শব্দটার স্ত্রী লিঙ্গ নেই।
হঠাৎ বুঝে ওঠে নারী সর্বদাই ধরণীজ কিংবা মাটি ফুঁড়ে ওঠা অঙ্কুরের মতোই চির উন্নত, প্রবহমান নদীর মতোই চিরন্তন তাঁর একাকিত্ব—