প্রায় শুনি বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ আসলে ধর্ষণ নয়। এটি আসলে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার রিফ্লেকশন। নারীর ভার্জিনিটিকে মূল্যায়ন করতেই এমন আইন। ক্লজটি নারীর জন্য অবমাননাকর। এছাড়াও শুনি ‘দুজনে মিলে সময় কাটিয়েছে’, ‘আনন্দ নিয়েছে’,তাহলে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণটা কী ? এটা খুবই হাস্যকর।’ ‘৩ বছর ধরে ৫ বছর ধরে সম্পর্ক সেটাই বা ধর্ষণ কীভাবে, সেটা খুব বেশি হলে প্রতারণা হতে পারে, ধর্ষণ নয়!’
বেশিরভাগ পুরুষরা বিষয়টিকে ঠিক এভাবেই দেখেছেন। অনেক আধুনিক মানুষ এমনকী নারীরাও ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ কে কনসেন্সুয়াল সেক্স বলতে চান এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইন থেকে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ ক্লজটি তুলে দেওয়ার পক্ষেই তারা কথা বলেছেন। এছাড়াও শুনেছি— ‘মেয়েটি হোটেলে গেল কেন’, ‘মেয়েটি সম্পর্ক করল কেন’ ‘মেয়েটি জানত না কেন’। মানে ভিকটিমকে জানতে হবে বুঝতে হবে যদি তা না করে তাহলে নিজেই ধর্ষণকে দাওয়াত দিয়েছে।
ধর্ষণ মানে তারা বুঝতে চান বাংলা সিনেমার মত মোটা কালো ভিলেনের দল মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যাবে, সেখানে অনেক বেশি শারীরিক ধস্তাধস্তি হবে, মেয়েটি ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করবে, মেয়েটির শরীরে বিশেষত গোপন অঙ্গে আঘাতের চিহ্ন থাকবে। এছাড়াও দয়ালু পুরুষ ধর্ষণের শিকার নারীটির পক্ষ নিয়ে তারা শক্তভাবে ধর্ষকের ফাঁসিও চাইতে পারেন তবে মেয়েটিকে হয় আত্মহত্যা করতে হবে বা তাকে মেরে ফেলা হলে । অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীটি আসলে তার পোশাক ও অঙ্গভঙ্গি দিয়ে ধর্ষণে প্রভোক করেছে। সুতরাং সেটি ধর্ষণ হলেও এর জন্য নারীটিই দায়ী।
ধরুন দুজন নারী-পুরুষের একটি প্রেমের সম্পর্ক হল। ঘনিষ্টতা বাড়লো। ওই সম্পর্কে বিয়ের পরিকল্পনা বা প্রতিশ্রুতি ছিল। ওই দুজন এডাল্ট নারী-পুরুষ শারীরিকভাবে মিলিত হলেন। পরে ছেলেটি বিয়ে করতে চাইল না। এখন মেয়েটি তাদের সম্পর্কটিকে ‘ধর্ষণ’ জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হল। এখন প্রশ্ন এই আধুনিক যুগে এই শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ বলা যায় কী না?
একটি মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারক বলেছেন, ‘হ্যা। বিয়ের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ‘ধর্ষণ’ বলে গণ্য হতে পারে।’ জাস্টিস নাগেশ্বরা রাও ও জাস্টিস এম আর শাহ বলেন, বিয়ে হবে বলেই মেয়েটি যৌন মিলনে সম্মতি দিয়েছেন। মানে সম্মতিটি ছিল বিয়ে সাপেক্ষে। বিয়ে না করার ‘স্পষ্ট উদ্দেশ্য’ ও ‘বিয়ের প্রতিশ্রুতি’ এ দুই বিষয় থাকলে ওই সম্মতিকে ‘সম্মতি’ বলে গণ্য করা যায় না। মামলায় ডাক্তার আসামির ১০ বছর কারাদণ্ড হলে উচ্চ আদালত সাজা কমিয়ে ৭ বছর করেছিলেন। এবং উচ্চ আদালত বলেন, অপরাধীকে তার কাজের পরিণাম অবশ্যই ভোগ করতে হবে।
আবার ভারতের কর্ণাটকে একইরকম ঘটনায় কোর্ট পুরুষটিকে ‘দোষী নয়’ ঘোষণা দিয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়। আদালত বলেন, প্রি-মেরিটাল শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ নয়। এর মানে কী? ওই একই ঘটনা। অথচ পরেরটি ‘ধর্ষণ’ নয়। কেন? কারণ দুজন এডাল্ট শিক্ষিত নারী-পুরুষের প্রেম হল যৌন সম্পর্কও হল এবং কোন কারণে সম্পর্কটি আর থাকল না। তবে সেখানে কোন ‘মিথ্যে প্রতিশ্রুতি’ দিয়ে বা ‘প্রতারণাপূর্ণভাবে’ সম্মতি নেওয়া হয়নি। এ ধরনের মামলায় আদালত পর্যবেক্ষণ করেন, যৌন তাড়না মেটাতে পুরুষ ‘বিয়ের প্রতিশ্রুতিকে’ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে কী না?
একটি শারীরিক সম্পর্ক কখন ‘সঙ্গম’ কখন ‘ধর্ষণ’ বিষয়টি নির্ণয় হবে সম্মতির উপর। অর্থাৎ সম্মতি থাকলে ‘সঙ্গম’, সম্মতি না থাকলে ‘ধর্ষণ’।
ধর্ষণ কী?
সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক হল ধর্ষণ। ধর্ষণের আইনি সংজ্ঞা হল— সম্মতি ছাড়া কোন ব্যক্তির (নারী বা পুরুষ) ‘যোনি’, ‘মলদ্বার’ বা ‘মুখ’-এ লিঙ্গ প্রবেশ করানো। ধর্ষণের সংজ্ঞার মূল কথাটা হল যৌন সম্পর্কটি হবে ‘সম্মতি’ ছাড়া।
সম্মতি কী?
যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্মতি হল স্ব-জ্ঞানে, জেনে বুঝে ও নির্দ্বিধায় শারীরিক সম্পর্কে যেতে ‘হ্যা’ বলাটাই সম্মতি। শব্দগুলো হল ‘স্ব-জ্ঞানে’, ‘জেনে বুঝে’ ও ‘নির্দ্বিধায়’। ‘স্ব-জ্ঞানে’ সম্পূর্ণ সুস্থ ও মানসিকভাবে সক্ষম অবস্থা। অপ্রাপ্তবয়স্ক, পাগল, মাতাল বা ঘুমন্ত অবস্থায় বলা ‘হ্যা’ সম্মতি বলে গণ্য হবে না। ‘জেনে বুঝে’ মানে সবকিছু জেনে যেমন ‘বিয়ের চুক্তি নেই’ এ বিষয়টি অপরপক্ষকে জানতে হবে। জেনেবুঝে সম্মতি না হলে ওই সম্মতিকে প্রতারণাপূর্ণভাবে নেওয়া সম্মতি বোঝাবে। ‘নির্দ্বিধায়’ মানে অপরপক্ষ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। কাউকে বন্দি করে, ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে, ম্যনিপুলেট করে নেওয়া হা সূচক মতামত সম্মতি হবে না।
যৌন চুক্তিটি বিভিন্ন ফর্মে থাকতে পারে যেমন ‘বিয়ে’ একটি যৌন সম্পর্কের চুক্তি। অর্থাৎ যৌন সম্পর্কের আগে জানতে হবে যে অপরপক্ষও যৌন সম্পর্কে যেতে চায় কী না? সম্মতি মানে হল উভয়কেই ওই যৌনতায় যেতে একমত হতে হবে। প্রতিবারের সম্পর্কেই আলাদাভাবে ‘সম্মতি’ লাগবে। এমনকি নারী বা পুরুষ যদি আপনার স্বামী বা স্ত্রী হন তবুও সম্মতি লাগবে।
ধর্ষণের শিকার কারা?
ধর্ষণের শিকার কী শুধু নারীরা হন? না। ধর্ষণের শিকার হতে পারে যে কোন বয়সের নারী পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গের কেউ। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা বেশি ধর্ষণের শিকার হন। এছাড়াও বিশেষভাবে অক্ষম পাগল ও প্রতিবন্ধী নারীরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হয়। অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলে ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল পুরুষও ধর্ষণের শিকার হন।
আমাদের নাটক সিনেমা ও উপন্যাসে ধর্ষণকে দেখানো হয়েছে বা বর্ণনা করা হয়েছে অনেকটা ইরোটিকভাবে। যে দৃশ্যগুলো ধর্ষণের ভয়বহতা নিয়ে পুরুষকে কোন ভাল ধারণা দেয় না। ফলে এটিকে ঘৃণ্যরূপে না দেখে তারা বরং ‘যৌন সুড়সুড়ি’ অনুভব করেছেন। কোন প্রলোভনে বা ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে ধর্ষণ করলেও শারীরিক ও মানসিক ক্ষতটা একই। যেমন মনে করুন বুঝতে পারেনা এমনভাবেই হঠাৎ কাছে এসে ছুরি চালিয়ে কাউকে হত্যা করা হল। আবার খুনীর সাথে খুনের শিকারের ধস্তাধস্তি হল মারামারি হল একপর্যায়ে শিকার হওয়া ব্যক্তি মারা গেল। মানে ‘খুন হয়েছে’ এটাই বিষয়। হ্যা খুনের ধরনের উপর ভিত্তি করে শাস্তির রকমফের হতে পারে।
ঠিক তেমনি ভায়োলেন্টলি হলেও ধর্ষণ, প্রতারণাপূর্বক বা হুমকি দিয়ে করলেও তাও ধর্ষণই। এবং সেটা ফৌজদারি অপরাধ। কনসেন্ট বা সম্মতির সংজ্ঞাও প্রায় সব দেশে একই। ভায়োলেন্ট রেপ, গ্যাং রেপ বা শিশুদের রেপ করা অপরাধটির একেবারেই জঘন্য পর্যায়। এর শাস্তিও দৃষ্টান্তমূলক দেওয়ার রীতিতে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের আইন একই।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনাগুলোতে দেখা যায়, মেয়েটি অনেকটাই স্পষ্টভাবে অসম্মতি জানায়। সম্মতি আদায় করতেই এই ‘বিয়ে করব শীঘ্রই’ কথাটি একটি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল টুল হিসেবে ব্যবহার হয়। যে মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে রাজি হবে না তাকে রাজি করাতেই এত সব ছল প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়। ভিন্নও হতে পারে। একটি দীর্ঘ কনসেন্সুয়াল সেক্সের পর নারীটি ধর্ষণের মিথ্যে অভিযোগও আনতে পারেন। ধর্ষণ ও সঙ্গমের বর্ডারলাইন হল সম্মতি। এটি প্রমাণসাপেক্ষ যে সম্মতি ছিল নাকী সম্মতি ছিল না। মানে প্রলোভন, প্রতিশ্রুতি, হুমকি ছিল না ছিলনা?