তিন বছর হলো বিয়ে করেছি। শাহানার সাথে বোঝাপড়াটা নিতান্তই খারাপ নয়। হ্যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে পরিমাণ রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে উঠে আমাদের ততোটা গাঢ় বা টানটান সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। তবে পারস্পরিক বোঝাপড়া আর সম্মানের জায়গাটা বেশ।
আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।
পাত্রী দেখা ও আনুষাঙ্গিক সব কাজ মায়ের পছন্দেই হয়েছে। আমাকে পাত্রী দেখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পছন্দ হয়েছে কি না! আমি বরাবরই একটু আত্মভোলা লোক। তাছাড়া বিয়ে সাদীর ব্যাপারে ‘লোক বিচারি’ বা বাহ্যিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে উদাসীন। আমার কাছে মানুষের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য কিম্বা গুণটাই প্রাধান্য পায়। তাই নির্দ্বিধায় সম্মতি জানিয়েছি।
তবে বিশ্বাসের জোরে এভাবে জিতে যাব এতোটা ভাবিনি। শাহানা আপাদমস্তক একজন সুন্দরী। সাথে সাহিত্য আর রন্ধন শিল্পে অসাধারণ একজন গুণী নারী।
কাব্য বোঝে। দারুণ সব রান্না বান্না করে।
সুশৃঙ্খল আচার আচরণ আর পরিশীলিতভাবে জীবন যাপনে অভ্যস্ত। আমার সাথে মাখামাখিটা কম। কিন্তু তাতে করে বৈবাহিক বা দাম্পত্য জীবনে খুব একটা প্রভাব পড়ে না।
সে হিসেবে আমরা সুখী দম্পতি বলতে পারেন। শাহানাকে পরম এক আস্থা আর নির্ভরতায় ভালোবাসি। তার খবর জানা হয়নি কখনো। কারণ জিগ্যেস করে জানা হয়নি আর এমন কোনো প্রয়োজন পড়েনি যে তা খতিয়ে দেখব। প্রশ্ন করে জানতে চাইও না “আমাকে ভালোবাসো?”
কিছু দিন হলো আমরা একা একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি। মা প্রবাসে ছোট বোনের ওখানে গেছেন আপাততঃ বছর তিনেক টানা থাকবেন কথা হয়েছে। তাই নিজেদের বড় বাসাটা ভাড়া দিয়ে এই ফ্ল্যাটে উঠা।
শাহানা আমি আর পুরনো গৃহকর্মী জমিলা।এই তিনজন।
আজ সকালে আমি অফিস যাবার সময় শাহানাকে ডেকে আনলাম সামনে ও সচরাচর সাজগোছ করে না। একটু এলোমেলো বা একটু কেয়ারলেস থাকে সে।অবশ্য তাতেই তাঁকে অপরূপ সুন্দরী লাগে।
যাবার বেলা আলতো করে কপোলে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
প্রতিদিন এমনটাই ঘটে সে ভাবলেশহীন থাকে তবে আমি জানি ও এই চুমুটির জন্য অপেক্ষায় থাকে। খুব গোপন মনে সে তা উপভোগ করে। পৃথিবীতে কিছু লোক থাকে তারা ভাবলেশহীন থাকলেও আসলে সবটাই উপভোগ করে, কেবল তার সাড়াটা সাধারণের মতো করে দেয় না।
সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখলাম শাহানা বেশ ব্যতিব্যস্ত।
ড্রয়িং রুমে নতুন ফুল। খুব টানটান আর গোছানো সবদিক। আমি কাপড় ছেড়ে শাওয়ার করে এসে জানতে চাইলাম -কি বিশেষ কিছু?
হেসে বললো না তেমন কিছু না। আমার কাজিন আর তার এক বন্ধু আসছেন। কাজিন মানে কামরান ভাই আর তার এক প্রবাসী বন্ধু। ফোন করে বললেন সন্ধ্যার পর আসবেন তাই একটু গুছিয়ে নিলাম।
আমি হালকা নাস্তা সেরে একটু কম্পিউটারে চোখ বুলাতে লাগলাম, জরুরি কিছু বিষয় আবারও ভালো করে দেখে রাখছি এমন সময় শাহানা এসে আমাকে একটু অনুনয়ের সুরে বললো পরণের কাপড়টা পালটে রুমে রাখা ওর পছন্দের কাপড়টা পরতে।
আমি কথা মতো তাই করে ড্রয়িং রুমে এসে বসলাম।
একটু পরই কলিং বেলটা বেজে উঠল।
জমিলা এগিয়ে যেয়ে নিচতলার দরজাটা খুলে দিল।দুজন ভদ্রলোক কথা বলতে বলতে উপরের দিকে উঠে এলেন।আমি ড্রয়িংরুমের দরজটা খুলে দিয়ে একটু দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম।
কামরান ভাই আমার চাচাতো সমন্বি ও সাথে সৌম্য দর্শন এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন।কামরান ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন ইনি আমার বন্ধু অমিত চৌধুরী আমেরিকায় থাকেন। আর ইনি হচ্ছেন শাহানার হাসবেন্ড হাসান আরিফ, আমাদের হাসান ভাই।
দুজনকে বসার অনুরোধ করে ভিতর রুমে যেতে চাইলাম ঠিক তখনই শাহানা এসে ঢুকল।
শাহানা এতো চমৎকার করে ঘরোয়া সাজে সেজেছে যে ইতিমধ্যে আমি তাঁকে এতোটা সুন্দর করে সাজতে বিগত তিন বছর ধরে কখনোও আমি দেখিনি।
শাহানা অপূর্ব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলো আর তার চোখ দুটো কয়েক সেকেন্ডের জন্য অপলক চেয়ে রইল সাথে আসা অমিত সাহেবের দিকে।
অমিত সাহেব যেন হারানো একটা বস্তু খুঁজে পেলেন বহুদিন পর তেমনটা মনে হলো।আমি দর্শক সারিতে বসে আপাততঃ তাদের হারানো দিনের নানা স্মৃতিচারণ শুনছিলাম। ইতিমধ্যে জমিলা এসে চা দিয়ে গেল সাথে হরেক রকমের নাস্তার আয়োজন। এতো স্বল্প সময়ে শাহানা এতোকিছু কিভাবে তৈরি করলো তা ভেবে বেশ আশ্চর্য হলাম।
কামরান ভাই তাদের কথায় কিছু খেই ধরিয়ে দেন আর শাহানা আর অমিত সাহেব বেশ জমে উঠেন। আমি অমনোযোগী শ্রোতা কেবল শাহানার চোখ দুটো দেখছি। সেই চোখ দুটো আজ আশ্চর্য সুন্দর। তবে খানিকটা অপরিচিত আর চঞ্চল মনে হলো।
আমি খুব একটা বিচলিত না হলেও একটা অশুভ খচখচানি টের পাচ্ছিলাম।
অমিত সাহেব একসময় স্থানীয় ব্যান্ড তারকা ছিলেন। খুব ভালো ভোকাল। সবার খুব প্রিয় আর পছন্দের শিল্পী ছিলেন তিনি। হবারই কথা এতো সৌম্য দর্শন আর সাথে যদি ভালো ভোকাল হন। তখন তো তাকে সবাই চাইবে। এ কথা সেকথার এক ফাঁকে অমিত সাহেব বিদায়ের জন্য উঠে দাড়ালেন আর হঠাৎ এগিয়ে এসে শাহানার হাতটা চেপে ধরলেন। হাতে বেশ কিছু টাকা সেটা জোর করে তুলে দেবার জন্য জোরাজোরি করতে থাকলেন।
শাহানা খুবই বিচলিত ও অপ্রস্তুত হয়ে উঠলে আমি আশ্বস্ত করে বললাম” নিয়ে নাও ভাই যখন দিচ্ছেন!
আপাততঃ কাজ হলো। অমিত সাহেব হাত ছাড়লেন। তবে তার চোখেমুখে একটা আনন্দ ছুয়ে গেল। শাহানা একটু ধাতস্থ হয়ে বিদায় জানাতে এগিয়ে গেল।
দু’দিন পরে শ্বশুর বাড়ি থেকে দাওয়াত এলো আমাদের। গতানুগতিক মাঝেমধ্যেই ডাক পড়ে আমি না করি না। কাজ না থাকলে দাওয়াত রক্ষা করি সবসময়।
যথারীতি রাতের ডিনার তবুও সন্ধ্যাতেই শাহানা তৈরি হয়ে নিল আমাকে তার পছন্দের পোশাক পরিয়ে, জমিলাসহ তিনজনই গাড়িতে চেপে বসলাম।
মিনিট ত্রিশেকের রাস্তা চটজলদি পৌঁছে গেলাম।
একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল কামরান ভাইয়ের বন্ধু অমিত সাহেবেরও দাওয়াত সেখানে। জানলাম একসময় আমার শ্বশুর পরিবারের সবার খুব ঘনিষ্ঠ জন ছিলেন। নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন। তিনি তাদের খুব পছন্দের লোক।তার গান আর কনসার্ট নিয়ে কথা চললো অনেকটা সময়।
একসময় আমি এশার নামাজের জন্য মসজিদে বেরিয়ে গেলাম। ফিরে এসে মনে মনে শাহানাকে খুঁজলাম। কিন্তু মুখে কাউকে জিজ্ঞেস করলাম না।একসময় দক্ষিণ দিকের একটু আলো আঁধারি ব্যালকনিতে শাহানাকে পেলাম সাথে অমিত সাহেব। একটু দূর থেকে দেখে সামনে যেয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করলো না। ফিরে এলাম।
সে রাতে খুব ভালো ঘুম হলো না। একটা অশুভ খচখচানি টের পাচ্ছি মনে।
তবে আমি শাহানাকে কোন কিছুই জিজ্ঞেস করতে গেলাম না। শাহানা বেশ আয়েশ করেই ঘুমোচ্ছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ।
স্নিগ্ধ অপূর্ব সুন্দর দীপ্তিময় মুখের কোথাও দুঃস্বপ্নের ছায়া নেই।
আজ শুক্রবার। বিকেল বেলা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বসে আছি। এমন সময় নিচে গাড়ির শব্দ, কিছুক্ষণ পর কলিং বেল বেজে উঠল। শাহানা জমিলাকে যেতে বলে ভিতর রুমে চলে গেল। ড্রয়িং রুমের দরজা খুলে দেখি অমিত সাহেব। একটু ঈষৎ গম্ভীর হয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। আমি হাতের ইশারায় বসতে অনুরোধ করে শাহানাকে ডাকলাম। তিনি আমাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন বসুন প্লিজ!
আমি আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। আমি সময়ক্ষেপণ না করেই বললাম বলুন প্লিজ।
দেখুন,অমিত বলতে লাগলেন – শাহানা আর আমি কলেজ জীবন থেকে পরিচিত ছিলাম। পরিচিত মানে আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম। সেই সময়ে আমার পারিবারিক চাপ ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় শাহানাকে বিয়ে করতে পারিনি।তাই জীবনের সফললতার জন্য আমেরিকা চলে যাই।কিন্তু সেখানে থিতু হতে আর স্থায়িত্ব পেতে বহুদিন লেগে যায়।
ইতিমধ্যে আমি বহুবার শাহানার সাথে কথা বলে ওকে সান্ত্বনা ও সাহস যুগিয়েছি কিন্তু তাদের পরিবার শেষ পর্যন্ত আমার ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে অপারগ হয়ে যান। আর তাই আপনি শাহানার বর হয়ে পড়েন। মুলতঃ শাগানা আমার আমানত আমার ভালোবাসা।
ইতিমধ্যে শাহানা পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে আছে আমি টের পাচ্ছি।
বললাম অমিত সাহেব ভুল বললেন একজন বিবাহিতা স্ত্রী কিছুতেই অন্য কারো আমানত হতে পারে না। শাহানা আমার স্ত্রী এবং এখন আমার ভালোবাসা।
তবুও অমিত সাহেব বললেন- ‘আমি শাহানাকে নিয়ে আমেরিকা চলে যাব।আপনি শুধু প্রয়োজনীয় কাগজ আই মিন ডিভোর্স পেপারস সাইন করে দেবেন।
ব্যস! ডান। আমি উইদিন টু মান্থের মধ্যে ওকে নিয়ে চলে যাবো। ওকে বলেছি। ও নিশ্চয়ই আমাকে এখনো ভালোবাসে এবং ও আমার সাথে চলে যাবে।
‘আপনি ওকে ডাকুন আর নিজ মুখে শুনে নিন।’
‘ভদ্রলোক আপনি আশা করি সম্মানজনক ভাবে সব কিছু শেষ করবেন।’
আমি বললাম, অমিত সাহেব আপনার বলাটা শেষ হলে আপনি এখন উঠতে পারেন। আমি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম হাতে বিনয়ী ভঙ্গিতে বেরিয়ে যেতে ইশারা করলাম।
তিনি বেশ জোরে জোরে বললেন- ‘শাহানা প্লিজ কাম আউট। আমি নীচে গাড়িতে অপেক্ষা করছি। ইটস ওভার প্লিজ কাম আউট।’
আমি ড্রয়িং রুমের দরজার কাছ থেকে সরে এসে চায়ের কাপের উপর থেকে পিরিচ সরিয়ে রেখে দিলাম। দরজাটা বন্ধ করে এলাম না।
শাহানা বেরিয়ে এসে ড্রয়িং রুমের দরজায় হাত দিলো।
নিচে গাড়ি থেকে হর্ন ভেসে আসছে…..।