সংসারকে ভালোবাসা মানে স্বামীকে ভালোবাসা—এ ধারণাতেই বাঙালি নারীরা নিজেদের জীবন কাটিয়ে দেয় সংসার নামের চার দেওয়ালের ঘরে। বিয়ের পর স্বামীর দায়িত্ব বাইরের কর্ম জগত সামলানো, স্ত্রীর দায়িত্ব ঘরের কাজকর্ম। হেঁসেলের হিসাব, স্বামী সন্তানসহ পরিবার পরিজনের দেখভালের বাইরে আর কোন ভাবনা থাকে না গৃহকত্রীর। এটাই যেন বাঙালি নারীর জীবন।
নন্দিতা রায় রচিত ‘ বেলাশেষে ‘ ছবিতে অবলা নারী আরতিকে একা বাঁচতে শেখার শিক্ষাটা বাঙালি নারী ও সমাজের বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন।
সিনেমায় দেখা যায় আরতির স্বামী বিশ্বনাথ মজুমদার (সৌমিত্র চট্রোপাধ্যায়) একজন সচেতন স্বামী হিসাবে স্ত্রীকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। তিনি সব সময় চেয়েছেন আরতিকে (স্বাতী মজুমদার) স্বাবলম্বী করতে। আরতি বিয়ের পর ৫০ বছর ধরে সংসার সামলেছেন সাবলীলভাবে। কিন্তু নিজের জীবন জগতের সব দায়িত্ব স্বামী প্রকাশক ও সাহিত্যপ্রেমী বিশ্বনাথ মজুমদারের উপর ছেড়ে দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে থাকতেন। তিনি বুঝতে চাইতেন না বাহিরের জগতকে। এমকি নিজের একান্ত কথাগুলোকে নিজের কাছে বন্দি রেখে দিয়েছেন চিরকাল। কোনদিন স্বামীকে ভালোবাসার কথাটাও মুখ ফুঁটে বলেননি। আরতি যেন হাজারো বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছবি।
হাজার বছরের নিয়মে বাঁধা নারীর জীবনেই অভ্যস্ত আরতি বাবার ঘর ছেড়ে আসার পর স্বামীর উপর নির্ভরশীল। আর স্বামীর অবর্তমানে সন্তানরা তার দেখভাল করবে এটাই জানেন। তাই তার নিজের অর্থ সম্পদের হিসাব বা খোঁজ খবর করে পরিচালনা করার কারণটা বুঝতে পারে না। এটাই এ সমাজের অবলা নারীদের চরিত্র। তাই স্বামী বলা সত্ত্বেও আরতি আর্থিক বিষয়ে উদাসীন ছিলেন। এমনকি আরতিকে সবল করার জন্য যখন ডির্ভোস দিবার সিদ্ধান্ত নিলেন বিশ্বনাথ মজুমদার তাও অবলীলায় মেনে নিলেন আরতি। কারণ অভ্যাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাতে স্বামীর খুশিকেই প্রাধান্য দিতেন আরতি।
ঝগড়া বিবাদ বা মান-অভিমান মনে পুষে রাখলে সংসার হয় না। তাই ৫০ বছরের সংসার জীবনে তিনি স্বামীকে বলতে পারেননি নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগার কথা। তেমনিভাবে বিশ্বনাথ মজুমদার বার বার আরতির প্রেমে পড়েও চাপা অভিমান নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন ৫০ বছর। নিজেদের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব বা ভালোবাসার আক্ষেপে নেই তবুও ।
আর তাই জীবন সায়াহ্নে এসে আরতিকে মুক্তি দিয়ে সবল করতে চেয়েছেন বিশ্বনাথ। যেন তার অর্বতমানে আরতি আত্মসম্মান নিয়ে নিজের মত জীবন কাটাতে পারে। শুধু এ কথা ভেবে আরতিকে ডির্ভোস দিতে চেয়েছেন। কারণ বিশ্বনাথ চলে গেলে আরতি বাস্তবতাকে জানবে শিখবে। নিজের মত করে চলতে শিখবে। স্বামী সন্তানই একমাত্র জীবন নয়। বিশ্বনাথের ডির্ভোসের সিদ্ধান্তে সন্তানরা প্রতিবাদ করলেও আরতি নির্বাক ছিল। তার কল্পনাতে আসে না বিশ্বনাথ তাকে ছেড়ে যেতে পারে।কিন্তু স্বামীর খুশিতে যে নারী সংসার জীবনের ৫০ বছর পার করেছে ; সে নারী স্বামীর খুশিরই জন্য আদালতে ডির্ভোস নিয়ে আপত্তি করেনি। এমনকি দীর্ঘ সময় পরে একান্ত আপনভাবে নিজেদের জানার পরেও স্বামীর খুশির জন্য সবল হবার শিক্ষা শুরু করে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীকে সবল করার জন্য প্রেমের ভিন্ন এক রূপ বিশ্বনাথ।
অন্যদিকে নিটোল প্রেমের অনুভূতিকে সাথে নিয়ে অবলা নারী আরতি মনোবল আর সাহস দিয়ে বাইরের জগতকে জেনেছে, চিনেছে। সবল হয়ে প্রমাণ করেছে নারী ঘর বাহির দুটোই সামলাতে পারে । যে আরতি কোনদিন স্বামী ছাড়া ঘরের বাইরে যায়নি সে আরতি স্বামীর অর্থের হিসাবের পাশাপাশি নিজের বাঁচার অবলম্বন ও খুঁজে পেয়েছে বস্তির নারীদের সেলাই শিখানোর দায়িত্ব নিয়ে।
ভালোবাসা মায়া মমতার বন্ধন নারীকে সংসারে অবলা নামে আখ্যায়িত করে এ সমাজ। আর এ অবলা নারীই নিজেকে ভেঙ্গে যে সবল করতে পারে তাই প্রমাণ করেছে নন্দিতা রায় তার বেলাশেষে ছবিতে।
আর সে কারণে স্বামীর একাকি জীবন নিয়ে যন্ত্রণার কথা শুনে ভগবানের কাছে আরতি প্রার্থনা করেছে, তার আগে যেন স্বামীর মৃত্যু হয়। কারণ আরতি স্বামীকে ছাড়া চলতে শিখে গেছে কিন্তু বিশ্বনাথ মজুমদার আরতিকে ছাড়া অচল। কারন স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা যে লেখক আর প্রকাশকের মত।
প্রকৃতপক্ষে বেলাশেষের ছবিতে ফুটে উঠেছে একটাই সত্য সেটি হল নারীকে আত্মসম্মানের সাথে বাঁচতে হলে সবল হতে হবে। ঘরের গন্ডির বাইরের জগতটা বুঝে না নিলে পরনির্ভরশীল হবার দূর্ভোগ পোহাতে হবে যে কোন বয়সে। ঘরের হিসাবের সাথে বাইরের হিসাবটা না বুঝলে চিরকাল অবলা অপবাদের গঞ্জনাটেই সইতে হবে।
লেখক – কলামিস্ট