বোরকা না শর্টস, আফগান না বাংলা, চয়েস না ফোর্সড এসব আলাপে আমাদের ব্যস্ত রেখে মিডিয়া কিন্তু এক দারুণ দাবার চালে আপোষে দু’দুটো কিস্তিমাত করে ফেলেছে তুমুল হৈচৈ করে ঝর্ণা আক্তার চিনির মুখে দুটো পুরনো অথচ ভয়ঙ্কর শক্তিশালী পুরুষতান্ত্রিক স্টেটমেন্টকে নতুন করে বেশ পোক্ত করে দিয়েছেন।
ঝর্ণা আক্তার বলেছেন, ‘…..আমার অ্যাথলেট জীবন আমি পিছে ফেলে এসেছি, সামনের নিজের জন্য কিছু চাই না। কেবল চাই আমার ছেলেটাকে বিকেএসপি পর্যন্ত পৌঁছে যেন দিতে পারি।’
বাহ! বটেইতো! সংসারের জন্য, সন্তানের জন্য অ্যাথলেট তাঁর খেলা ছেড়ে দেবেন, শিল্পী গান ছেড়ে দেবেন, চিত্রকর ছবি আঁকা ছাড়বেন, পেশাজীবী পেশা ছাড়বেন, শিক্ষার্থী পড়ালেখা ছাড়বেন, ডাক্তার হাসপাতাল ছাড়বেন, নাট্যকর্মী মঞ্চ ছাড়বেন..তবেইনা নারী ‘ভালো মা’ ‘ভালো মেয়েমানুষ’ হয়ে উঠবেন!
নারীর নিজের কোন জগৎ থাকবে না, যোগ্যতা থাকবে না, পরিচয় থাকবে না, সক্ষমতা থাকবে না, দক্ষতা থাকবে না, নারী কেবল সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবেন, স্বামীর আরামের ভাত আর বিছানার ব্যবস্থা করবেন, সবাইকে সুখে শান্তিতে রাখবেন, তবেইনা নারীর স্বার্থকতা! ‘মাতৃত্বেই নারীর স্বার্থকতা’, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’….তাইনা!
তাই খেলোয়াড় পরিবারের ছোটভাই রোকনুজ্জামান কাঞ্চন যখন জাতীয় ফুটবল দলের স্ট্রাইকার হয়ে নিজের ক্যারিয়ার সফল করছেন, তখন বড়বোন ঝর্ণা আক্তার বিয়ে করে, সংসার পেতে, সংসারের জন্য সবকিছু ছেড়ে দিয়ে মিডিয়ার বদৌলতে হাততালি কুড়িয়ে বলছেন, ‘আমার জীবনে কোনও হতাশা নেই, নিজের জন্য আর কিছুই চাইনা’…ব্যাস! আর কী লাগে!
আমাদের মতো ঘর ভাঙানো, হাড় জ্বালানো, রোজগেরে মেয়েদের প্রতাপে অতীষ্ট নারীপুরুষের সামনে স্বামীর তেল সাবানে পোষ্য নারীদের জন্য ‘ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত’, ‘নিজের জন্য কিছুই না চাওয়া’ একজন বাস্তব শাবানার ‘রোল মডেল’ উপহার দিতে পেরে আমাদের মিডিয়াও খুশি, আমরাও খুশি। ঘর শান্তি তো দুনিয়া শান্তি!!
এরপরের স্টেটমেন্টটি তো আরো টুইস্টিং, ‘পর্দা (বোরকা) কোনও কিছুর জন্য বাধা হতে পারে না’। আরেব্বাহ! এই মডারেট ইসলাম বোঝানোর জন্য এই দেশে কতো বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ঘরানা ইনভেস্ট করে চলছে ধর্মভিত্তিক অর্থনীতি, সংস্কৃতির পেছনে, অথচ কতো স্মুদলি এই কাজটি করে ফেলল আমাদের মিডিয়া, আমরা টেরও পেলাম না। দেশ ছাপিয়ে বিদেশের আকাশ পাতাল মাটিতে ছড়িয়ে পড়লো রোল মডেল! ‘আদর্শ’ ‘মাতৃত্বের মডেল, ‘নিজের জন্য কিছুই চাইনা মডেল ‘, ‘বোরকা পরেও সব করা যায় মডেল’। একের ভেতরে তিন! রাজনীতি একেই বলে, বুঝলাম আমরা!
তো, এই হলাম আমরা। বরাবরই চোখের সামনের মাছি তাড়াতে তাড়াতে আমাদের ব্যস্ত রেখে পেছনে বিশাল বিশাল হাতি নির্বিঘ্নে নিয়ে যায়, আমরা খেয়াল করার সময়ই পাই না। উপরের শ্যওলা ছাড়াতে ছাড়াতে কেনো নিচের আগাছায় জড়িয়ে তলিয়ে যাচ্ছি সেই আলোচনাতেই আমরা কখনও যাই না।
আমরা আলোচনায় যাই না, কেন নারীর ক্ষমতায়নে ‘বিপ্লব’ ঘটে যাওয়া দেশে এখনো একজন অ্যাথলেট নিজের খেলোয়াড় জীবন পেছনে ফেলে দিয়ে সংসার করাকেই ‘সফলতা’ ভাবছেন? কেন নারীবাদ চর্চা করা নারীরাও নিজের সক্ষমতা আর স্বাধীনতার জায়গাটাতে আপোস করে সঙ্গীর পকেটকেই সার্বভৌম করে রেখে তাকে ‘রাইট টু চয়েস’ বলে স্টাবলিশড করছেন?
‘বোরকা না বিকিনি’, ‘আফগান না বাংলা’ এই তর্কের চাইতে আমাদের জন্য জরুরি আলোচনা ছিলো, কেনো শিক্ষিত, স্বচ্ছল মেয়েরা, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মেয়েরা, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো পর্যন্ত হিজাব-বোরকাকেই পোষাক হিসেবে ‘পছন্দ’ করছেন? এসব পছন্দ বা মনস্তাত্তিক বিবর্তনের পেছনে এক্স ফ্যাক্টরগুলো কী?
পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হয়েছে, এই দেশকে সেক্যুলারিজম থেকে বিচ্ছিন্ন করে রিলিজিয়াস কোলাবোরেট বানানোর জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে তা গত তিন দশকে আমরা কী দিয়ে, কতটুকু মোকাবেলা করেছি? আদৌ করেছি কিনা?
করলে আধুনিক বোরকার মতো এক্সপেন্সিভ এবং আবহাওয়ার জন্য প্রতিকূল একটি পোষাক এই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কোন যাদুর কাঠিতে? শুধুই ধর্মের ভয় বা সমাজের চাপ? নাকি এই চাহিদা নির্মাণে আন্তর্জাতিক বাজার রাজনীতির ভূমিকাটা আরো ভয়ঙ্কর?
কেনো কলকাতা-দিল্লী-মুম্বাইয়ের মতো হিন্দুপ্রধান শহরগুলোতেও বোরকা-হিজাব-খিমারের বড় বড় আউটলেটে উপচে পড়া ভিড় থাকে? এই মিলিয়ন বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের বিশাল বাজার কার হাতে, কারা নিয়ন্ত্রণ করে? যে অস্ত্রবাজরা তাদের স্বার্থে ধর্ম বিস্তার করে, পর্দা বিস্তারের এই বিশাল বাজারও তাদের আয়ের উৎস কিনা? নাহ, এসব ঝুঁকিপূর্ণ আলোচনা আমরা করি না। আমরা শুধু হালকার উপরে হিজাব-নেকাব-বোরকা-খিমার-বিকিনি-সালোয়ার-কামিজ-ওড়না-শাড়ি-স্লিভলেস-অফসোল্ডার-জিন্স-টপস এসব ঝাপসা তর্ক করে আমাদের কাজ শেষ করি।
‘নারী কেন পর্দা করবে এবং নারী কেনো পর্দা করবে না?’ এই দুই লাইনেই আমাদের সমস্ত জ্ঞানচর্চা শেষ হয়ে ফুলস্টপ পড়ে যায়। আমাদের মগজ এটুকুই নেয়। এটুকু দিয়েই নারীর অধিকার, নারীর স্বাধীনতা সব প্রতিষ্ঠা করে ফেলছি আর কি আমরা!
সাদিয়া নাসরীন- প্রধান নির্বাহী সংযোগ বাংলাদেশ