ফিশ রিভারে মাত্র ১০ হাজার টাকাই তার পুঁজি। আর কোন পুঁজি যোগ হয়নি। কেবল লাভের টাকাটা খরচ না করে আবার পুঁজি বানিয়েছেন। অথচ অনেকের কাছেই ব্যবসার উদ্যোগ মানেই ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া। ব্যবসার এ তত্ত্বের ধারেও ঘেঁষেননি কুমিল্লার মেয়ে ফারজানা আক্তার। পেশায় সাংবাদিক হলেও উদ্যোক্তা হয়েছেন এক বছর আগে। নারীরা কীভাবে উদ্যোক্তা হবেন, কীভাবে নিজের আইডিয়াকে বাস্তব করতে পারেন সেটি তিনি দেখিয়েছেন অনেকটা ম্যাজিকের মত। তার কথায়, ‘ই-কমার্স নিয়ে ও দেশি পণ্য নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের বাঁচতে হলে কাজকে অনলাইনভিত্তিক করতে হবে। সেটাই এখন কৌশল।’
তিনি বলেন, ‘করোনার লকডাউনে অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভাল কাজ করেছে। এতে আমাদের অর্থনীতি সচল থাকবে। ই-কমার্সে ব্যবসা বা যে কোন কাজের ক্ষেত্র অনেক বড়। আমাদের কাজ শুরু করতে হবে শুধু।’
কিছু একটা করব ভাবতে ভাবতে শুরুটা করেছিলেন ঠিক একবছর আগে। মাছ নিয়ে কাজ করবেন ভেবে মাছ নিয়ে তিনি পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতা নিতে থাকেন। কোথা থেকে মাছ আনবেন কারা হবে তার ক্রেতা শুরুতেই ভেবে রেখেছিলেন। বেতনের ১০ হাজার টাকায় ‘ফিশ রিভার’ নামে একটি অনলাইন পেজ খোলেন। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের জেলেদের কাছ থেকে মাছ এনে তিনি শুরুতে বিপণন করেছিলেন ঢাকা নগরীতে। তিনি প্রাকৃতিক উৎসের মাছকে নগরবাসীর হাতে তুলে দিয়েছেন। রেস্ট্যুরেন্ট বা অফিসসহ এখন তার অনেকেই তার মাছের ক্রেতা। তার মতে, ‘হাওড়- ঝিলের মাছ নগরে পাওয়া যায়না, আবার গ্রামের মানুষও তাদের আহরণ করা মাছ বিক্রির ক্ষেত্র কম পান। ওই মাছকে পরিচয় করালাম নগরের মানুষকে।’
ই-কমার্সের সম্ভাবনাকে তিনি যেন নতুন করেই দেখালেন। একটি ফেসবুক পেজ দিয়েই মাছ বিক্রি করে খুব দ্রুত আস্থা অর্জন করেছিলেন ক্রেতাদের। তার অনলাইন পেজের এখন অফিসও আছে। পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ফারজানাকে। ৬-৭ মাস নিজের হাতেই সবকিছু করেছেন। এখন তার দৈনিক বিক্রি ৪০ হাজার থেকে ১লাখ টাকা।
১০ হাজারের টাকার পর আর কোন পুঁজিও বিনিয়োগ করতে হয়নি। ব্যবসা বড় হলে তিনি যুক্ত করে নিয়েছেন এক ঝাঁক তরুণ-তরুণীকেও।
ফারজানা বলেন, ‘একবছর আগে শুরু। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে একটু একটু করে কাজ শুরু করতে থাকি। প্রথম দিকে মাছ সংগ্রহ করাটাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। স্পট বেছে নিয়েছিলাম কিশোরগঞ্জ। কেননা সেখানে নদী এবং হাওর দুটোই আছে। ঘাটে একজন লোক ঠিক করেছিলাম যিনি আমার মাছ কালেক্ট করে দিতেন। ঢাকায় অন্যান্য যেসব মাছের বড় গাড়ি আসে, সেসব গাড়িতে তিনি আমার মাছ তুলে দিতেন। ভোর রাতে মাছ ঢাকা এসে পৌঁছাতো। মাছ আমার বাসার কাছের পয়েন্টে গাড়ি থেকে কালেকশন করে, মাছ মাপা ও প্যাকিংয়ের কাজ নিজেই করতাম।’
ফারজানা বলেন, ‘আমি ব্যবসা করে আয়ের পাশপাশি ক্রেতার হাতে ভালো মানের পণ্য পৌঁছে দিতে চেয়েছি। সে কারণেই দ্রুত আস্থা অর্জন করতে পেরেছি ক্রেতাদের। সারাদেশের হাওড়-পুকুর ও নদীর ফ্রেশ মাছ ডেলিভারি করেছি। ফ্রোজেন বা ফরমালিন দিয়ে প্যাকেটজাত করে নয়। এখন কেবল মাছ নয় দেশি মোরগ ও গাছপাড়া ফলও যুক্ত হয়েছে। এছাড়াও খাঁটি সরিষার তেল ও ঢেঁকিছাটা চালও বিক্রি হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রিভার ফিশ থেকে আমার মাসিক আয় প্রায় ৯ লাখ টাকার মত। ব্যবসার পরিধি বাড়ায় স্টাফ সংখ্যাও বেড়েছে। আমার এখন স্থায়ী স্টাফ ১৯জন। পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করেন আরও কয়েকজন। এখান থেকে ডেলিভারিম্যানরাও মাসে ২০-৫০ হাজার টাকা আয় করেন।’
ফারজানা বলেন, খুব অল্পদিন আগে আমি অন্যান্য পণ্য বিক্রির জন্য নতুন পেজ খুলি ‘ফেরিওয়ালা ঢাকা’ নামে। নতুন হলেও ওই পেজ থেকেও রোজার মাসে প্রায় ২৬ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে।
অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায় নতুনদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ডিজিটাল মার্কেটিং-এ শুধু অভিজ্ঞতা থাকলে হবে না। কারা আপনার ক্রেতা সেটি প্রথমেই ঠিক করে নিতে হবে। কারণ একটি পণ্যের সবাই ক্রেতা হয় না। ব্যবসায় শ্রম ও সততা দুটোই থাকতে হবে। তাহলেই সফল হওয়া সম্ভব। ‘
প্রসংগত, ফারজানার জন্ম কুমিল্লায় হলেও তিনি শৈশবের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে। পড়াশোনা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। ব্যবসায় সফল হবার পরও এখনও তিনি পুরোদস্তুর সাংবাদিক। দীপ্ত টিভিতে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার পর এখন কাজ করছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনে।