আসমা আমার মেয়ের নতুন হাউজ টিউটর। একটা কলেজে অনার্স পড়ে। আমার স্ত্রী তার সাথে কথা বলে মেয়ের জন্য রেখেছে। মেয়েটাকে খুব সহজ সরল মনে হল। প্রথম দিন এসে একটা সালাম দিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে রইলো। আমার মেয়ে জাইমা যে একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশু তা আসমাকে আগে বলা হয়নি কেবল কোন ক্লাসে পড়ে তা বলা হয়েছে।
আসমাকে ভিতরের রুমে ডেকে নিয়ে গেল আমার স্ত্রী রুমা
জাইমার এই সমস্যা চিহ্নিত হওয়ার পরে থেকে আমরা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করি। ডাক্তার অরবিন্দ একজন অটিস্টিক চিকিৎসক। তিনি জাইমাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে জানালেন জাইমার জন্মের সময় পেটে পানি ভেঙ্গে গেলে গর্ভাশয়ে শুকনো অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ থাকাতেই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। শেষ পর্যন্ত তিনি এ রোগের চিকিৎসা হিসেবে অত্যধিক স্বাভাবিক জীবন যাপন ও অন্যান্যদের মতো করে স্বাভাবিক আচরণ করাটাকে গুরুত্ব দিতে বললেন। তার বিকাশটা অন্যান্য নরমাল বাচ্চাদের সাথে থেকেই সম্ভব জানালেন।
আসমার পূর্বে আরও দুজন শিক্ষক অল্প সময়ের মধ্যেই ইস্তফা দিয়ে চলে গেছেন। তাদের অপারগতার স্বীকারোক্তি দিয়ে বলে গেছেন তাদের দ্বারা হবে না।
আসমা ভিতরে যাওয়ার পর আমি ড্রয়িং রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে কাটালাম কারণ আসমার প্রথম রিয়েকশনটা বুঝতে চাই শুনতে চাই।
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পরে আসমা বেরিয়ে এলো। ভিতরে জাইমার রুমে ওকে পড়াতে বসেছিল। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকালাম। আসমার কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া না দেখে নিজেই জিজ্ঞেস করলাম –
কেমন দেখলে ছাত্রীকে?
আসমা হেসে জবাব দিলো ভাবি বললেন ওর সমস্যার কথা। কিন্তু আমিতো তাকে আট দশটা স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতোই দেখলাম। শুধু ওর রেসপন্সটা একটু স্লো হয়। আর ওর অন্য যেসব আচরণ গত সমস্যা আছে তার প্রায় সত্তর আশি ভাগ অন্যান্য নরমাল বাচ্চাদের বেলায়ও ঘটে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আমি আপনার সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
একটা মেয়ে আমাদের সবচেয়ে অসহায় আর কষ্টের জায়গাটা নিয়ে আশ্বস্ত করে কথা বলছে দেখে দরজার পাশে দাড়ানো রুমা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমিও একটু আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। আসমাকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা হারিয়ে গেল। তাই চোখের ভাষায় তার প্রতি ধন্যবাদ জানালাম।
এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিন আসমা আসতে লাগলো আর জাইমাকে ঘণ্টা দু ঘণ্টা সময় নিয়ে পড়াতে শুরু করলো। আসমা গভীর মনোযোগ দিয়ে জাইমাকে সব বিষয় গুলো বুঝায়। সাথে সে বিভিন্ন ধরনের টুলস ব্যবহার করে যাতে জাইমা ভালো করে সেসব বুঝতে ও শিখতে পারে।
জাইমাকে যে স্কুলে আমরা ভর্তি করিয়েছি সেখানে আর আট দশটা স্বাভাবিক বাচ্চাদের সাথে তাকেও খেলতে দেয়া হয়।এভাবে মিশতে দেয়ার ফলে জাইমা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তার আচরণ, কথা বলা কিম্বা পড়া লেখার মধ্যে পার্থক্য ধরা পড়ে।
আমিও রুমা অনেকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি।
একদিন আসমাকে ড্রয়িং রুমে বসাই। তারপর তাকে বলি আজ তোমার সাথে কথা বলবো।
সে জানতে চাইলো কি ব্যাপারে?
আমি তাঁকে তার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলাম।
সে খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বললো
আমরা দুই বোন ও এক ভাই। খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। আমার বাবা একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। আমার মা একজন মানসিক প্রতিবন্ধী।
আমার ছোট ভাইয়ের জন্মের সময় থেকে হঠাৎ করেই আমার মা কিঞ্চিৎ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। আমি পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে মায়ের এমন সময়ে মা’কে সাহায্য করতে শুরু করি মায়ের হয়ে নিয়মিত কাজগুলো করে দিতাম। এভাবে একসময় পরিবার সামলে নিজের লেখাপড়াটা চালিয়ে নিতে শুরু করি।
আমি জাইমাকে প্রথম দিন এসে দেখে একটা কথাই মনে মনে বলি আমার মায়ের জন্য করতে পারি তাহলে একটা শিশুর জন্য কেন নয়! মায়ের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান বা মা’কে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে আসলে আমি আমার আমাকে একটা মানসিক শক্তিতে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছি।ইনশাআল্লাহ আমার বিশ্বাস জাইমা একদিন পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে। স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে।
আমার মন চাইলো আসমাকে মন প্রাণ খুলে দোয়া করি। তাঁকে বললাম তোমার মা’কে দেখতে যেতে চাই একদিন। আসমা মুখটা নিচু করে বসে রইলো। জানতে চাইলাম কি হলো আসমা নেবে না আমাদেরকে?
আসমা চোখ তুলে চাইলো।
ওর দু চোখ দিয়ে তখন নোনাপানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সে দ্রুত তা মুছতে মুছতে বললো
স্যার, আমার মা কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন।
বাবা বিছানায় পড়ে আছেন একবছর ধরে। আমি জাইমাকে আমার তৃতীয় একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখি।
নিতান্ত একটা বিশ একুশ বছরের মেয়ের মুখে এতো অদম্য মনোবল আর শক্তির কথা শুনে মনটা ভরে উঠলো। আমি আসমাকে বললাম
মাগো তোমার জন্য তোমাদের জন্য আমাদের আগামী পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে। আমি উঠে যেয়ে একটা বড় অঙ্কের চেক হাতে নিয়ে এলাম। ওর হাতে দিয়ে বললাম এ টাকা গুলো দিয়ে তুমি কিছুটা স্বচ্ছলতা পাবে আশা করি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে আসমা বললো—‘ স্যার, হয়তো আমার অসচ্ছলতাটাই আমার শক্তির কারণ। প্লিজ আমাকে দূর্বল করে দেবেন না।যদি কখনো তেমন কোনো প্রয়োজন পড়ে আমি আপনাকে জানাবো।’
মেয়েটি মাথা উঁচু করে আমার দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
কিছু মাথা বা মনকে সহজে নত করে ফেলা যায় না বোধ হয়…