খবর লহরিয়া— এটি এমন এলাকার নারীচালিত সংবাদপত্র যেখানে বিদ্যুৎও নেই। নাগরিক হওয়ার নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত উত্তর ভারতের দলিত দরিদ্র নারী। সেই বিদ্যুৎহীন নিশ্চল এলাকা ভারতের উত্তর প্রদেশের বুন্দিলখন্ড অঞ্চল জুড়ে নারী সাংবাদিকদের একটি দল বিশ্বকেই যেন তোলপাড় করে দিয়েছে। এ প্রতিবেদক নারীরা নারীর জীবনের গল্প লেখেন, পুরুষতান্ত্রিক বিদ্বেষের গল্প আর সে গল্পের প্রেক্ষিতে সামাজিক নিপীড়নের নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন।
সুস্মিত ঘোষ এবং রিন্টু থমাসের নতুন একটি ডকুমেন্টারি রাইটিং উইথ ফায়ারে এ প্রতিবেদক নারীদের গল্প এবং ন্যায়বিচারের জন্য তাদের আবেগঘন সংবাদ মিশনকে স্ক্রিন জুড়ে দেখিয়েছে। ডকুমেন্টারি সিনেমায় উঠে এসেছে প্রধান প্রতিবেদক মীরার নেতৃত্বে ওই প্রতিবেদকের দলটি কীভাবে মুদ্রণ থেকে ডিজিটালে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাতে তারা আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে।
ভারতের দলিত শ্রেণির নারীদের দ্বারা পরিচালিত সংবাদমাধ্যম ‘খবর লহরিয়া’-কে নিয়ে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র এ বছর অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। হিন্দু বর্ণপ্রথায় সবচেয়ে নিগৃহীত এই গোষ্ঠীটির নারী সাংবাদিকতা জগতের চ্যালেঞ্জ ফুটে উঠেছে এই তথ্যচিত্রে।
যেখানে বিদ্যুতের সুবিধাটুকুও অনিশ্চিত এমন একটি এলাকায় সংবাদপত্র তাও আবার নারীচালিত—এ সহজ কীর্তি নয়। দলিত সংবাদকর্মীদের মধ্যে অনেক নারী এখনও স্মার্টফোনের এক্সপোজার করেননি।, প্রতিবেদক শ্যামকালী একটু ভয় একটু ইতস্তত করে জানান, ‘স্মার্টফোন চার্জ না করলে কী ক্ষতি?’
সুস্মিত ঘোষ এবং রিন্টু থমাস খবর লাহারিয়ার নারীদের সাথে আমাদের যাত্রাকে যেন সংযুক্ত করে দিলেন। এসব নারী প্রতিবেদকেরা চাইনিজ স্মার্ট ফোনের আলোয় ওই অঞ্চলের খবরকে কভার করতে শুধুমাত্র ভিকটিমদের সাক্ষ্য নয়, তাদের মুখ, কণ্ঠ এবং কান্নাও রেকর্ড করতে পারেন। স্মার্ট ফোনের ডিজিটাল ক্যামেরাটি অনেকের জন্য রেকর্ড এবং মেমরি উভয়ই হয়ে ওঠে।
এ নারীরা যে যে নিউজ স্টোরিগুলো করেন তা মুখে বর্ণনা করা কঠিন। হ্যাঁ, তাদের বিষয়বস্তু হৃদয় বিদারক। নারী প্রতিবেদকরা অনেক বাধার মুখে পড়েন। প্রতিদিন তাদের কাজের প্রতিটি মুহূর্তে লিঙ্গ এবং বর্ণের সামাজিক সীমাবদ্ধতায় আটকে যায়।
ভারতের নিম্নতম সামাজিক ও ধর্মীয় বর্ণের সদস্য এই দলিত নারীরা। নারীমাত্র অবজ্ঞার তবে দলিত নারীদের দ্বিগুণভাবে অবজ্ঞা করা হয়। সুনীতা নামের খবর লহরিয়ার এক নারী প্রতিবেদক একটি স্থানীয় খনিতে শ্রম লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির তদন্ত করেন সাহস নিয়ে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহী কর্মকর্তা, কর্মকর্তা এবং অন্যান্য পুরুষ সাংবাদিকরা তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন কারণ তিনি একজন নারী এবং তারা মনে করেননা তাদের খবর করার মতো তথ্য উপাদান আছে।
পুরুষতন্ত্র এবং হিন্দু জাতিবাদ সরাসরি এইনারীদের মুখোমুখি। সমাজের অনমনীয় লিঙ্গ এবং শ্রেণি বিভাজন ভারতীয় পুরুষদের শেখাচ্ছে নারী উপেক্ষা। তাই নির্বাচনের মৌসুমে যখন খবর লহরিয়ার সাংবাদিকরা কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের মুখোমুখি হন তখনই তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ পিতৃতন্ত্রের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
‘রাইটিং উইথ ফায়ার” শিরোনামের ছবিটি এই প্রতিবেদক নারীদের প্রশংসা করে। যখন রাইটিং উইথ ফায়ার এ নারী সাংবাদিকদের সাথে যোগ দেয় তখন তাদের YouTube চ্যানেলটি এক লাখ ভিউ অতিক্রম করে ফেলে। সংখ্যা ধীরে ধীরে প্রতিটি নতুন গল্পের সাথে বাড়বে খবর লাহারিয়া নারী সাংবাদিকতার এক উজ্জল উদাহরণ হয়ে উঠে দাঁড়াবে।
‘রাইটিং উইথ ফায়ার” শিরোনামের ছবিটি এবারের অস্কারে সেরা তথ্যচিত্র বিভাগে মনোনীত হয়েছে। কয়েক দশকের পুরনো মধ্য ভারতের স্থানীয় ভাষার সংবাদপত্র ‘খবর লহরিয়া’ কীভাবে ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে, সেই প্রক্রিয়া উঠে এসেছে এই তথ্যচিত্রে।
ছবিটির নির্মতা সুস্মিত ঘোষ ও সহ-নির্মাতা রিন্টু থমাস বলেন, আমরা ৫ বছর ধরে আমাদের তথ্য চিত্র নিয়ে কাজ করছি। গ্রামের এই সুবিধাবঞ্চিত নারীরা কীভাবে ছাপা মুদ্রন থেকে ডিজিটাল পথে এগুল তা আমাদের চোখের সামনে। ৩২ নারী প্রতিবেদক ও সংবাদকর্মদের নিয়ে গঠিত খবর লহরিয়া ভারতের উত্তর প্রদেশের বুন্দিলখন্ড অঞ্চলে কাজ করে। এই অঞ্চলটি ভারতের সবচেয়ে জনবহুল দুই প্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের মাঝখানে অবস্থান করছে। পিতৃতন্ত্রের রক্তরোখ বর্ণকেন্দ্রিক উপেক্ষাকে অতিক্রম করে এ নারী গ্রামীণ স্বাস্থ্য, বন ও পানি সংরক্ষণ, বৈষম্য, মহামারীর বিস্তার এমনকি আফগানিস্তানের মতো বিষয় নিয়ে সংবাদ উপস্থাপন করে।
এদিকে, অস্কার মনোনয়নের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর খবর লহরিয়া নিউজ পোর্টালটি একটি টুইটের মাধ্যমে তথ্যচিত্রের দুই পরিচালককে অভিনন্দন জানিয়েছে। টুইটে আরও বলা হয়, “এই অস্কার মনোনয়নের মাধ্যমে আমাদের নারী-নেতৃত্বাধীন তৃণমূল মিডিয়া বিপ্লবকে আরও এগিয়ে নিতে উৎসাহিত করা হয়েছে”।
উল্লেখ্য, খবর লহরিয়ার প্রতিবেদক ও সম্পাদকদের মধ্যে মুসলিম এবং স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায়ের মতো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নারীরাও আছেন। এ নারী সংবাদকর্মীদের কিশোরী বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তবে স্কুল শিক্ষা শেষে তাদের সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।