নিচের ছবিটিতে একটি ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে৷ ছবির চরিত্রগুলো ভালো করে লক্ষ্য করুন। নীল শাড়ি পরা একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির পাশে একটি ছেলে আছে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটি সিগারেট টানতে টানতে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এমন সময় গোলবৃত্ত চিহ্নের ভেতরের লোকটি আসে। এসেই তিনি মোরাল পুলিশিং শুরু করেন। মেয়ে হয়ে সিগারেট কেনো খাবে। লজ্জা-শরম নেই। বেহায়া মেয়ে। ওই লোকটির ধমকাধামকি শুরুর মিনিটের মধ্যে আরও লোকজন জড়ো হয়ে যায়। গোলবৃত্তের সাথে তারাও সুর মেলায়। একপর্যায়ে মেয়েটিকে সিগারেট নিভিয়ে ফেলতে বাধ্য করা হয়। শেষে মেয়ে ও ছেলেটিকে ওখান থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়।
রাজশাহীর ধূমপায়ী নারীর উপর ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি খুব সাধারণ ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি তুচ্ছ নয়। ওই মেয়েটিকে সিগারেট নিভিয়ে ফেলতে এবং ওই স্থান থেকে চলে যেতে বাধ্য করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের অন্যতম প্রধান মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। ওই অধিকারটি হচ্ছে তার “ফ্রিডম” ও “লিবার্টি” এবং সেইসাথে নাগরিকের চলাফেরার স্বাধীনতা।
আমেরিকার আইনের অধ্যাপক বাটলার শাফার বলেন, ‘লিবার্টি (স্বাধীনতা) হল এমন একটি অবস্থা যা সমাজে একত্রে বসবাসকারী মুক্ত মানুষের মাধ্যমে উদ্ভুত হয়। লিবার্টি একটি সামাজিক অবস্থা। স্বাধীনতা হ’ল অভ্যন্তরীণ দার্শনিক এবং মানসিক অবস্থা। কোনও ব্যক্তির দেহ শারীরিকভাবে বন্দি হতে পারে তবে তার মন নয়।
সংক্ষেপে বলা যায়— স্বাধীনতা মানুষের অন্তর্নিহিত অধিকার। মানব গুণে মানুষের মধ্যে স্বাধীনতা বিদ্যমান। লিবার্টি হল স্বাধীনতার রাজনৈতিক গঠন যা মানুষকে সম্পত্তির অধিকার, বাকস্বাধীনতা, মেলামেশার স্বাধীনতা, আন্দোলনের স্বাধীনতা ভোগ করায়।
৭১’র মুক্তিযুদ্ধের (লিবারেশন ওয়ার) প্রতিশ্রুতি মতে দেশের প্রতিটি নাগরিক তার সার্বজনীন অন্তর্নিহিত স্বাধীনতা উপভোগ করবে। নাগরিকের এই জাতীয় স্বাধীনতা উপভোগ করার স্বার্থে সাংবিধানিক গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে (অবশ্য যদি, কিন্তু সহযোগে বিস্তর বাধানিষেধ সাপেক্ষে)।
ছবির এই মানুষগুলো ওই মেয়ের (নারী ধূমপায়ীর) সহজাত স্বাধীনতার চেতনা ও সাংবিধানিকভাবে গ্রান্টেড লিবার্টিকে আঘাত করেছে। জনপরিসর (পাবলিক স্ফিয়ার) ব্যবহারের তথা চলাফেরার (মোবিলিটি) সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে। এই কাজ আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য।
এবার বুঝার চেষ্টা করি মোরাল পুলিশিং বলতে কী বোঝায়? এর বাংলা কী হতে পারে – দাদাগীরী, নীতি রক্ষক? যাহোক, আইনগত প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ ব্যতীত ধর্মীয় অনুশাসন, প্রথা, আইন, ট্যাবু, পিতৃতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধ মানতে বাধ্য করার সামাজিক অথোরিটিকে বলা হয় মোরাল পুলিশ।
ছবির ওই লোকগুলো ধূমপায়ী নারীটির সাথে মোরাল পুলিশিং করছে। উর্দীবিহীন এই পুলিশেরা তাদের আরাধ্য ও পছন্দনীয় সামাজিক কাঠামো টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক আইনগত কাঠামোকে উপেক্ষা করে। এটা একইসাথে রাষ্ট্রের অকার্যকারিতাকেও নির্দেশ করে।
আইনে নির্ধারিত পাবলিক প্লেসে ধূমপানের শাস্তি ৩০০ টাকা জরিমানা। আইনটি এমন নয় ছেলে ধূমপান করলে ৩০০ টাকা দিতে বাধ্য থাকবে, মেয়েটি করলে টাকার বদলে ধিক্কার। একজন পুলিশ বা ইউএনও বা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ছবির মেয়েটিকে বড়োজোর ৩০০ টাকা জরিমানা করার অধিকার রাখে, এর বেশিকিছু নয়। আর ওই লোকগুলোর তো কোনো অথোরিটিই নেই ছেলে-মেয়ে দুজনকে কিছু বলার।
এই জাতীয় ঘটনার প্রাদুর্ভাব বন্ধ করা না গেলে এটি সমগ্র সমাজকে গ্রাস করবে। প্রতিটি মানুষের হাঁটাচলা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, সমস্তকিছু নজরদারিতে চলে আসবে। প্রতিটি মুসলমানকে টাকনুর উপরে প্যান্ট পরতে ফতোয়া দেওয়া, মেয়েদের সিগারেট খেতে দেখলে ঝাপিয়ে পড়া, ভাস্কর্য ও মূর্তি থাকতে পারবে কী পারবে না নির্ধারণ করা দেওয়া, পার্কে ও পাবলিক স্পেসে ছেলেমেয়েকে একসাথে বসতে না দেওয়া এ সবকিছু একটার সাথে আরেকটি সম্পর্কিত। বদলে যাওয়া, বদলে দেওয়া সমাজের করুণ চিত্র। এই জাতীয় সমাজের প্রধান শিকার নিশ্চিতভাবেই হবে নারী।
পিতৃতান্ত্রিক ধর্মান্ধ সমাজ কাঠামো নারী-পুরুষের জেণ্ডার রোল ঠিক করে দিয়েছে। ওই ছকের বাইরে দেখতে, শুনতে, চিন্তা করতে এমনকি আমাদের অপেক্ষাকৃত অগ্রসর সচেতন বন্ধুটিও অক্ষমতার প্রকাশ করে ফেলে।
ধর্মান্ধ পিতৃতান্ত্রিক মোরাল পুলিশে আচ্ছন্ন এই সমাজের নজরদারী ও চোখ রাঙানিকে তুচ্ছজ্ঞান করে একজন নারীর প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ দেখে কেঁপে ওঠাদের সাথে যারা “ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” সাইনবোর্ড নিয়ে হাজির হয় সেইসব স্বাস্থ্যসচেতন বন্ধুদেরকেও পুনর্পাঠ জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিষয়টি এমন নয় তো, “সিগারেট ছেলেদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে তাদের চরিত্রের জন্য ক্ষতিকর?”