‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে কোভিড-১৯ ঘোষণার পরই ধারণা করেছিলাম হয়ত করোনা ওয়ার্ডেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। যদিও আমি বেসিক সাবজেক্টের লেকচারার তাই ভেবে নিয়েছিলাম হয়ত আরও একটু দেরিতে করোনা ওয়ার্ডে ডাক পড়বে। রোজায় একটি এসএমএস আমাকে নিশ্চিত করল আমার দায়িত্ব পড়েছে ৯-১৫ মে। কোভিড-১৯ নিয়ে সবাই আতংকে আর আমার জন্যও বিষয়টি বেশ আকষ্মিক ছিল।’
‘নিজের মনকে প্রস্তুত না করেই যাওয়ার জন্য গোছগাছ শুরু করলাম। কেমন একটা অজানা আশংকা ও ভীতি মনকে আচ্ছন্ন করছিল। ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম যন্ত্রের মত। যখনই মেয়েটা সামনে এসে পড়েছিল তখন ভেতরটা কেম দুমড়ে-মুচড়ে উঠেছিল। চোখ ভিজে উঠছিল অযথাই। কেমন যেন একটা অনুভূতি। ভয়ের চেয়ে বেশি হচ্ছিল আপনজনদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট। তারপর থেকে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।’
কথা হচ্ছিল ডাক্তার তাহমিনা আক্তারের সাথে। ৩৩তম বিসিএস পাশ করে লেকচারার পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন ঢামেকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফিজিওলজি পড়ান। ২০১৭ সালে ফিজিওলজি থেকে এমফিলও সম্পন্ন করেছেন তিনি। তিনি একজন নারী, একটি শিশুর মা। করোনাযুদ্ধে অকুতোভয় একজন ফ্রন্টলাইন ফাইটার। সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও পেশাগত দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। শোনালেন করোনাযুদ্ধে তার অভিজ্ঞতার কথা।
উইম্যান ভয়েস প্রতিবেদক: এ ঝুঁকির পরিস্থিতিতে পেশাগত দায়িত্ব কীভাবে পালন করছেন?
ডা. তাহমিনা: দায়িত্ববোধ ও দায়বদ্ধতা থেকে। হাসপাতালের রোস্টার অনুসারে আমাদের টানা ৭দিন কাজ করতে হয়। তারপর ১৪দিন আইসোলেশনে থাকি। ওই পুরো সময়টা আমাদের হোটেলেই থাকতে হয়। হোটেল রিজেন্সিতে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপরের ৭দিন পরিবারের জন্য বরাদ্দ। সে সময়টা বাসায় যেতে পারি। পরিবারের জন্য ওই সময়টুকুই পাই।
উইম্যান ভয়েস প্রতিবেদক: ভয় লাগে না?
ডা. তাহমিনা: সব গুছিয়ে বাসা থেকে যাওয়ার সময় ভয় আসে। পরিবারের কেউ যখন ফোন করে কান্না পায়। শাশুড়িকে মোমো খাব বলেছিলাম। বলেই ভূলে গিয়েছিলাম। দেখি তিনি সেটি তৈরি করে পাঠিয়েছেন। মেয়েটার জন্যও কষ্ট হয়। কিন্তু দায়িত্বে ঢুকে পড়লে ভয় পাওয়ার আর সময় থাকে না। স্বাভাবিক নিয়মেই কাজ করে যাই। আমাদের প্রফেশনটাই এমন। রোগীর প্রাণ বাঁচাই বলে আমাদের কাজকে নোবেল প্রফেশন বলে। সে দায়িত্ববোধ থেকে নিজেকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
উইম্যান ভয়েস প্রতিবেদক: পরিবারের নিরাপত্তার কী ডাক্তারদের পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়?
ডা. তাহমিনা: হ্যা, পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টিতো আছেই। সাথে বাড়িওয়ালা ও সোসাইটিরও চাপ থাকে। অনেকের এমন সমস্যা হচ্ছে। এজন্য হোটেলে ডাক্তারদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দায়িত্ব পালনকালে আমাদের সেখানেই থাকতে হয়।
উইম্যান ভয়েস প্রতিবেদক: পরিবার আপত্তি করে?
না। স্বামী-শাশুড়িসহ আমার পরিবারেরও সব সদস্য খুব সহযোগিতা করেছে। দুশ্চিন্তাও করে না তাও নয়। ওরা ফোন করলে আমারও খুব মন খারাপ হয়। শুধু তাদের কাছ থেকে দূরে থাকি বলে। জীবনের ভয়ে নয়। মাঝে মাঝে ভাবি আর যদি দেখা না হয়!
উইম্যান ভয়েস প্রতিবেদক: ঢামেককে কোভিড -১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণার পর কী করোনা আক্রান্ত রোগী আসার সংখ্যা বেড়েছে?
ডা. তাহমিনা: আমার ৭দিনের দায়িত্ব ছিল ট্রায়াগে (জরুরি বিভাগ)। সেখানে সাসপেক্টেড এবং কনফার্ম কেস দুটোই যথেষ্ট সংখ্যায় এসেছে। এভারেজে প্রতিদিন ১১০-২৫০ রোগী থাকত। সাসপেক্টেডদের যদি উপসর্গ থাকে যেমন অক্রিজেন স্যাচুরেশন ৯০ এর কম থাকে সেক্ষেত্রে আমরা তাকে ভর্তি করে নিই। আবার যদি করফার্ম কেস হলেও উপসর্গ না থাকে বা রোগীর অবস্থা স্বাভাবিক মনে হয় সেক্ষেত্রে আমরা তাকে উপসর্গ অনুসারে ওষুধ প্রেসক্রাইব করে বাসায় পাঠিয়ে দিই। প্রতিদিন ঢাকার বিভিন্ন জেলা বিশেষত নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা তিন ভাগের একভাগ কোভিড-১৯ সাসপেক্ট অথবা কনফার্ম কেস।
তারমধ্যে লেবার পেইন নিয়েও অনেক নারী এসেছেন।
এর আগে সাসপেক্টেড বা কনফার্ম কেস উপসর্গ থাকেলেই ভর্তি করা হত। তখন গড়ে ৪০০-৪৫০ সিট খালি থাকায় সেটা করা হত। এখন রোগীদের সংখ্যা বাড়ায় সবাইকে ভর্তি করা হচ্ছে না। কেবল যাদের ক্লিনিক্যাল অ্যসিসটেন্স দরকার তাদেরই ভর্তি করা হয়। কোভিড প্যাশেন্টদের তো আর গাদাগাদি করে ফ্লোরে রাখা যায় না। সেটি আরও বিপজ্জনক হবে তাদের জন্য।
উইম্যান ভয়েস প্রতিবেদক: কোন কোন ডাক্তার ভয়ে কাজে আসতে চাইছেন না। এটা কী সত্যি?
ডা. তাহমিনা: দেখুন আমরা দেশ ও সরকারের প্রতি দায়বদ্ধ। সেটি পালনও করছি। কিছু তো ব্যতিক্রম থাকবে। এছাড়া যারা অনারারি কাজ করছে তারা তো কোন বেতন পায় না। ঝুঁকি নিয়ে ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয়টি ভেবে তাদের কেউ কাজ করতে না চাইলে সেটা তো বলা যায় না। এমবিবিএস পাশ করার পর একজন ডাক্তারকে অনেক স্ট্রাগল করেই পেশায় থিতু হতে হয়।
উইম্যান ভয়েস প্রতিবেদক: কোভিড-১৯ বিষয়ে সাধারণদের জন্য কিছু বলুন?
ডা. তাহমিনা: করোনার স্বীকৃত চিকিৎসা নেই। আবার কোভিড-১৯ পজিটিভ হলেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে তা কিন্তু নয়। এটি একেবারেই ভুল ধারণা। করোনায় যারা পজিটিভ হচ্ছেন তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ নিজেদের শরীরে থাকা ইমিউনিটি দিয়েই সুস্থ হতে পারে। বাকী থাকে ২০ শতাংশ। তারমধ্যে ৫ শতাংশের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ার কারণে অক্সিজেন সাপর্ট বা প্রয়োজনীয় ক্লিনিক্যাল সাপর্ট দিলেও তারা সারভাইভ করতে পারেন না। এই অংশটি মৃত্যু ঝুঁকিতে। বাকী ১৫ শতাংশ যাদের ট্রিটমেন্ট দিলে রিকভার করেন। তাদের নিয়েই আমাদের কাজ।
উইম্যান ভয়েস প্রতিবেদক: আদাজল, রং চা, লেবু বা গরম পানির ভাপ এমন বিভিন্ন হোম রিমেডির কথা জানতে পারছি। এগুলো কী করোনা ঠেকাতে পারে?
ডা. তাহমিনা: তারা ওই ৮০ শতাংশের দলে। এমন না যে আদা বা গরম জল খেয়েই তারা সুস্থ হচ্ছেন। তাদের ইমিউন ব্যবস্থা তাদের সুস্থ হতে সাহায্য করছে। এছাড়া হোম রিমেডি আপনি নিতেই পারেন। এতে কোন বাধা তো নেই। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ম্যালেরিয়া ড্রাগ বা কোন অ্যান্টিবায়োটিক খেলে আপনার ক্ষতি হতে পারে।
ডা. তাহমিনা আক্তার রুনা জন্মেছেন চাঁদপুর জেলায়। শৈশব কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রাম নগরের ইস্পাহানি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইসএসসি পাশ করার পর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। তারপর ৩৩তম বিসিএস পাশ করে লেকচারার পদে যোগ দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ২০১৭ সালে ফিজিওলজি থেকে এমফিলও সম্পন্ন করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত ও কন্যা আরশিয়া সেহের এর মা।