নাজমা বেগম। তিন সন্তান নিয়ে থাকেন। স্বামীর মৃত্যুর পর হঠাৎ করে ঝড় নেমে আসে তার জীবনে! তিন সন্তানকে কীভাবে মানুষ করবেন, কীভাবে তাদের লেখাপড়ার খরচ চালাবেন এ নিয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখেন। স্বামীর মৃত্যুর পর আত্মীয় স্বজনেরা যৎসামান্য সাহায্য করলেও তেমনভাবে এগিয়ে আসেনি কেউ!
নাজমা জীবনের এই কঠিন সময়ে মনোবল হারাননি। শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামলেছেন। প্রথমেই সন্তানদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করে নিয়েছেন। কিভাবে সংসার চলবে? কত আয়? ব্যয় ইত্যাদি। তার সন্তানেরা আজ প্রতিষ্ঠিত।
কথা হচ্ছে নাজমা বেগমকে কী বিরুপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি? হয়েছে অবশ্যই। একটি পরিবারে একজন থাকার অভাব পদে পদে বুঝেছেন নাজমা বেগম। এক একটি সমস্যা এসে সামনে দাঁড়িয়েছে আর বার বার স্বামীর কথা ভেবেছেন, ভেবেছেন তিনি থাকলে হয়তো জীবনটা আরও একটু সহজ হতো কী!
‘পরিবার’ বলতে সবার মনে প্রথমেই যে ছবিই ভেসে উঠবে সেখানে বাবা, মা, সন্তানের মেলবন্ধনের সুন্দর একটি সংসার। যেখানে বাবা মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা, দায়িত্ব কর্তব্য থাকে, থাকে সন্তানেরও ভূমিকা। এই সুন্দর নিয়মের ছন্দপতন ঘটে যখন পরিবার থেকে বাবা অথবা মা কেউ একজন চলে যান।
এরকম পরিবারগুলোকে সমাজবিজ্ঞানে ‘সিঙ্গেল প্যারেন্টিং ফ্যামিলি’ বা ‘একক অভিভাকত্বের সংসার’ বলা হয়।
‘একক অভিভাবকত্ব’ শব্দের মধ্যেই যেন রয়েছে বিষণ্ন এক সুর!মন খারাপের বেদনা!
একক অভিভাবকত্বে সঙ্গীর অনুপুস্থিতিতে (মৃত্যু বা ডিভোর্স) সন্তান পালনের কঠিন দায়িত্বটা যে কোন একজনের কাঁধে এসে পড়ে। তবে সামাজিক বাস্তবতায় পুরুষের চাইতে নারীর জন্য ‘একক অভিভাবকত্ব’ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং! যখন কোন নারীকে একক অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিতে হয়, তখন তাঁকে বোঝাপড়া করতে হয় এই সমাজ,পরিবার, সন্তান সর্বোপরি নিজের সাথে! সন্তানের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পুরো ও দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার দায়িত্ব এককভাবে নেওয়া ছাড়াও নিঃসঙ্গ জীবনের ক্লান্তি, হতাশা তো আছেই! আছে অর্থনৈতিক চাপ!
এদিকে রুপালী সন্তান হওয়ার দু বছর পর ডিভোর্স নিয়েছেন স্বামীর কাছ থেকে। একা মা হিসেবে দায়িত্বের চাপ অবশ্যই অনেক বেশি ছিলো তার জন্য। তার সাথে যোগ হয়েছিল সমাজের নেতিবাচক ফোঁড়ন। একসঙ্গে ‘বাবা-মা’ দুই দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তাকে। ডিভোর্স হওয়ার পর স্বামী নিজের সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল না হওয়ায় তার জন্য আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল বিষয়টি। অর্থনৈতিক চাপ ছাড়াও সন্তানেরা যাতে বাবার অভাব অনুভব না করে, অথবা বাবার শাসন ছাড়া বিগড়ে না যায় তা নিশ্চিত করার কথা ভাবতে ভাবতে তিনি হিমশিম খান।
এমন অনেক ‘মা-ই আছেন যারা একক অভিভাবকত্বের দায়িত্বে। একক অভিভাবকত্বের ভূমিকায় যখন আসতে হয় একজন মাকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, সংবেদনশীল এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হয়। কখনও কখনও হতে হয় কৌশলীও।
তবে সন্তান লালন-পালনে একক অভিভাবকত্বের কিছু সমস্যাও দেখা যায়। এ সময় কী করবেন—
বাড়তি মানসিক চাপে কী করবেন?
কখনও কখনও একক অভিভাবকদের সন্তানকে নিয়ে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, অতিরিক্ত শাসন, অতিরিক্ত উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষ করে একক অভিভাবক যদি হন নারী তবে তাকে বাড়তি মানসিক চাপ বয়ে বেড়াতে হয়। সামজিক বাস্তবতা নারীর জন্য খুব অনুকূল নয়।
এ ক্ষেত্রে একক অভিভাবক হিসেবে একজন মাকে প্রায়শই সন্তানকে অতিরিক্ত আগলে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখা, ভাবেন সন্তানেরা বাবা না থাকার কারণে হয়তো বিগড়ে যেতে পারে! শাসন নাও মানতে পারে এই আশঙ্কায় আরও বেশি বেশি শাসন করেন! যা সন্তানের জন্য সুফল এর চাইতে কুফলই বয়ে আনে।
সেক্ষেত্রে মাকে একটু কৌশলী হতে হয় এবং প্রয়োজন হলে আত্মীয়-স্বজনের সাহায্য নিতে পারেন।
মনে রাখবেন শাসনের কড়াকড়ি সন্তানকে বিগড়ে দিতে পারে তাই শুরু থেকেই সন্তানের সাথে সহজ সম্পর্ক গড়ে তোলাই উচিত। একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে সন্তানকে কিছু কিছু দায়িত্ব দেবেন। সংসারের ব্যাপারে মতামত নিয়ে শুরু থেকেই তা;রে দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলুন। এতে সন্তানের মধ্যে দায়িত্বশীলতা, আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয় জন্মে যা তার পরবর্তী জীবনে পথ চলায় সাহায্য করে।
সন্তানকে সময় দেওয়া
একক অভিভাবক হিসেবে সন্তানকে কতটুকু সময় দেবেন। সময়টা কীভাবে দিচ্ছেন সেটা বেশি কতটা সময় দিচ্ছেন সেটার চেয়ে। একসঙ্গে গল্প করা, মুভি দেখা, সন্তানের বন্ধুবান্ধব বিষয়ে খবর রাখা, সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া। এটাকে গুণগত সময় বলে। গুণগত সময় বা কোয়ালিটি টাইম আপনার সন্তানের মানসিক বিকাশের একটি অংশ। পরিকল্পনা করে সময় নিয়ে সন্তানের সাথে সময় কাটান।
নিজের প্রতি যত্ন নিন
মনে রাখবেন আপনি ভালো থাকলে সন্তানকে ভালো রাখতে পারবেন। তাই নিজের স্বাস্থ্য ও মানসিক সুস্থতার প্রতি যত্নশীল হোন। নিজেকে সময় দিন। যা ভালো লাগে করুন। মনে রাখবেন আপনার একাকীত্ব যেন একজ অভিভাবকেত্বের দায়িত্বকেই গ্রাস না করে ফেলে!
লেখক- প্রাবন্ধিক