‘বাচ্চা হওয়া’, ‘সন্তান জন্ম দেওয়া’ আমার আরাধ্য ছিল না। আমি ভাবতাম মা হওয়া আমার জীবনকে একেবারে অসম্ভব করে দেবে। মাতৃত্ব মানে হল একাকী মাতৃত্ব। কেবল বারবার ন্যাপি বদল করা ও শিশুর কান্না থামানো বা নিদ্রাহীন একাকী মাতৃত্বের ভয় ছাড়াও আমার মূল ভয় ছিল আমার মানসিক অবস্থা। যা মোটেও ভাল ছিল না। হ্যা, গত তিন বছর ধরে মানসিক রোগের সাথে লড়ছিলাম আমি। আমার ওই উদ্বেগ যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল গর্ভাবস্থায়। আমার মানসিক অসুস্থতা যখন আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিল তখন আমার সদ্য জন্ম নেওয়া একটু মোটা শিশুটিকে দেখে আমার সুন্দর অনুভূতি এসেছিল।
আমি লিখছি রিচমন্ড পার্কে একটি ঝুঁকে থাকা কিছুটা আধভেজা একটি গাছের তলায় বসে। আমার ছেলে জ্যাকব পাশেই তার প্র্যামে আরাম করে ঘুমুচ্ছে। যা কিছু হয়েছে তা আমার আরাধ্য ছিল না। আমি বুঝলাম যতটা সহজে ব্যাখ্যা করে মাতৃত্ব অতোটা সহজ নয়। বিশেষ করে যখন রাতে আমি অসংখ্যবার চেষ্টা করতাম নিজেকে জাগিয়ে রাখতে সেসব কথা কেউ বলেনি কখনও।
একটি দেবশিশু ও মায়ের ডেথ ডিক্লোরেশন
আমার ব্যক্তিগত জীবনের তীব্র মানসিক আঘাত আমাকে ট্রম্যাটিক করে তোলে। ডায়াগনস্টিক টেস্টে শনাক্ত হয় পোস্ট ট্রম্যাটিক ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)। গত ৩ বছর যাবত আমি সেটির সাথে এডপ্ট করে চলার চেষ্টা করছি। আমার ছেলে জ্যাকব এ বছরের (২০২০) ১২ মে জন্মগ্রহণ করে, লন্ডনসহ সমগ্র ব্রিটেন তখন পুরোপুরি লকডাউনে।
সেটি ছিল ২০১৯ সাল। টেলিভিশন লাইভে ছিলাম তখন। টেলিভিশন সেটে আমার পাশে বসে ছিলেন একজন রাজনীতিক। তখনই বমির উদ্রেক হল। মনে হল রাজনীতিকের উপরই আমাকে বমি করতে হবে। নিশ্চিত হতে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাই। টেস্টে আমি পজিটিভ হলাম। সবকিছু যেন মুহূর্তেই বদলে যাচ্ছিল।
দাম্পত্য পুনরুদ্ধারে মামলা, স্ত্রীকে ফিরে না পেয়ে স্বামীর আত্মহত্যা
তখন সবে আমি আমার মানসিক অবস্থাকে কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছিলাম। ঠান্ডা জলে সাঁতার কেটে,দৌড় প্র্যাকটিস করে, পাখি দেখে, পাখিদের ছুঁয়ে আমি তখন সবে জীবনে ফিরতে চাইছিলাম। আমি একটি বই লিখছিলাম তখন। তখন আমি জীবনকে হালকাভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ছিলাম। ওই তিন বছরে আমি আমার মানসিক সমস্যা কাটাতে নিজেকে অনেক সময় দিতে শুরু করেছিলাম। ঠিক তখনই অনেকটাই অনাকাঙ্খিত মাতৃত্ব নিজের অনুভব করলাম।
মাতৃত্ব ও মায়ের দায়িত্বের কথা ভেবে গর্ভাবস্থায় আমি আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। নিজেকে একসময় আমি বলেছিলাম আমি কখনও মা হতে পারব না। গর্ভাবস্থা আমাকে যেন অকেজো করে তুলছিল। যখন লকডাউন ঘোষণা হল, তখন আমার আতঙ্ক আরও বেড়ে গেল। আমার শিশুটি এলে তাকে নিয়ে বের হওয়ার অনুমতি কী আমি পাবো? ডেলিভারির সময় ঘনিয়ে আসছিল তখন আমার মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আরও খারাপ। লকডাউনের মধ্যেই লন্ডনের কিংস্টোন হাসপাতালে আমার ছেলে জ্যাকবের জন্ম হয়। ওই সময়ে হাসপাতালে আমার মানসিক অবস্থাকেও পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি।
মাতৃত্ব সহজ নয় তবে ‘মাতুত্ব’ পাওয়া আমার কোন বন্ধু আমাকে বোঝায়নি আমি একটি অদ্ভূত ভালোবাসা অনুভব করব। জ্যাকবের স্বস্তির জন্য আমি রাতগুলো জাগব। মধ্যরাতের সেই অনুভূতির কথা কেউ উল্লেখ করেনি।
লকডাউনের গ্রীষ্ম চলতে চলতে আমি শিখেছি বাচ্চার যত্ন নিয়েও আমার মানসিক স্বাস্থ্যের দেখাশোনা করা সম্ভব। আমাকে শুধু একটু সৃজনশীল হতে হবে। না আমি এখন ‘দৌড়ে’ যেতে পারছি না আমি অলস বিকেলে ঠান্ডা জলে সাঁতার কাটতে পারছি না। তবে বাইরে বসেও আমার মনকে আমি শান্ত রাখতে পারছি।
আমি এখন আঙ্গুল দিয়ে আমার আনন্দ গুণি। গ্রীষ্মের ঝরাপাতা কুড়িয়ে, বাদাম গাছের ডাল পরিস্কার করে হাঁস দেখে। এসব দেখে জ্যাকবও আনন্দে হেসে ওঠে।
ইসাবেল হার্ডম্যান: লেখক ও সাংবাদিক (যুক্তরাজ্য)
দ্যা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত লেখার ভাবানুবাদ