লু্জাইন আল হাথলুল—সৌদি আরবের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিচার সম্পন্ন হল যে নারীর তিনি কেবলমাত্র মানবাধিকার ও অ্রাক্টিভিজমের অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে জেলে বন্দি আছেন দুই বছর ধরে। সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ফৌজদারি আদালতে (এসসিসি) বিচার চলছিল তার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সৌদি আরবের আইন ও বিচারপ্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলা। সেটাই হল সন্ত্রাসবাদী হওয়া। তিনি বর্তমানে সৌদি আরবের জেদ্দায় অবস্থিত ধাবন জেলে বন্দি রয়েছেন।
সৌদি আরবের অন্যতম প্রধান নারী অধিকার কর্মী লুজাইন আল হাথলুলকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ অপরাধের জন্য ৫ বছর ৮ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে। তিনি সৌদি আরবের নারী অধিকার কর্মী, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও বর্তমানে সৌদি কারাগারে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে আটক রয়েছেন। ৩১ বছর বয়সী লুজাইনকে ২০১৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অপহরণ করে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে জেলে রাখা হয়েছে। এর আগে তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছিলেন। লুজাইন আল-হাথলুল সৌদিতে নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার ও পুরুষের অভিভাবকত্ব বিলোপের জন্য আন্দোলন করেছিলেন।
রায়ে বলা হয়—অ্যাক্টিভিস্ট লু্জাইন আল হাথলুল তার মুক্তির পর তিন বছর ধরে প্রবেশনে থাকবেন। তার পরিবারের বিবৃতির উপর ভিত্তি করে পাঁচ বছরের জন্য তার বিদেশে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হবে বলেও জানিয়েছে আদালত। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করতে হাথললের হাতে আর ৩০ দিন সময় বাকী রয়েছে।
নির্যাতন ও কারাগারের শর্তের প্রতিবাদে লু্জাইন আল হাথলুল দুবার অনশন করেছেন ও নিজের আত্মীয় ও পরিবারের সাথে যোগাযোগ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। লু্জাইন আল হাথলুলের স্বামী ফাহাদ আল বুতাইরিকে স্ত্রীকে তালাক দিতে চাপ দিয়েছিল সৌদি সরকার।
সোমবার (২৮ ডিসেম্বর, ২০২০) লু্জাইন আল হাথলুলের পরিবার একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন। লুজাইন আল-হাথলুলের পরিবার জানায়, তিনি ইতিমধ্যে ২ বছর সাজা ভোগ করেছেন।
গত মাসে সৌদি ফৌজদারি আদালতে লু্জাইন আল হাথলুলের বিচারে তার বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবাদ’ অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হয় পুরুষের অভিভাবকত্ব আইনের বিরুদ্ধে অ্যাকটিভিজম এবং বিদেশি সাংবাদিক এবং কূটনীতিকদের সাথে যোগাযোগ, জাতিসংঘে চাকরির আবেদন। তার মামলাটি বিশেষায়িত ফৌজদারি আদালতে (এসসিসি) স্থানান্তর করা হয়েছিল।
এদিকে এ বছরের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে তার পরিবার প্রকাশিত অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, লু্জাইন আল হাথলুলের বিরুদ্ধে বিদেশের সরকার এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীদের সাথে তার সম্পর্ককে সৌদি কিংডমের আইন ও বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এই নভেম্বরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সৌদির এই বিশেষায়িত ফৌজদারি আদালতকে ত্রুটিযুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অ্যামনেস্টি বলেছে—আদালতটি মোটেও নিরপেক্ষ নয়। মতবিরোধ থেকেও তাদের দীর্ঘ ও ত্রুটিপূর্ণ বিচারব্যবস্থা মানবাধিকারকে ক্ষুণ্ন করে।
সোমবার (২৮ ডিসেম্বর, ২০২০) লুজাইনের বোন লিনা বলেন, লু্জাইন আল হাথলুলকে তাড়াতাড়ি বিচারের জন্য ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন’ ব্যবহার করে অভিযুক্ত করা হয়েছে, বিচার করা হয়েছে এবং দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। অথচ অ্যাক্টিভিজম ছাড়া লুজাইনের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। আমার বোনকে কারাগারে নির্যাতনের ব্যপারে এক চোখা ওই আদালতটি কোন তদন্ত করেনি।
জেল থেকে লু্জাইন আল হাথলুল তার পরিবারকে জানিয়েছেন, কারাগারে তাকে নির্যাতনের জন্য ওয়াটারবেডিং, বেত্রাঘাত ও বৈদ্যুতিক শকসহ যৌন নির্যাতনও করেছে। এদিকে সৌদি সরকার নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে যে, ‘আমাদের আইন নির্যাতনের সমর্থন, প্রচার বা মঞ্জুরি দেয় না। এছাড়াও ফৌজদারি ওই বিশেষ আদালতের বিরুদ্ধে হাতললের পরিবারের বিবৃতিতে এসসিসির বিচারকও তার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, অ্যক্টিভিজম কোন অপরাধ নয়। হাথলুলের সাথে গ্রেপ্তার হওয়া আরও তিনজন নারী অধিকার কর্মী রয়েছেন তারা হলেন নাসিমা আল-সাদা, নওফ আবদুল আজিজ এবং মায়া-আল-জহরানী। তারাও জেলে আটক রয়েছেন।
সৌদিতে থাকা বিভিন্ দেশের রাষ্ট্রদূতরা বলেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ অ্যাক্টিভিজম এবং নারীর অধিকারের পক্ষে সমর্থন থাকা কোন অপরাধ নয়। এ বিষয়ে দেশটির মানবাধিকার কর্মীরা উদ্যোগী হতে পারেন।
সৌদির আর এক শীর্ষস্থানীয় নারী মানবাধিকার কর্মী সমর বদাওয়িরের মামলাটিও এখন বিশেষ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। বদাওয়ি নারীদের গাড়ি চালানো নিষেধাজ্ঞা, তার সাবেক স্বামী অধিকার কর্মী ও আইনজীবী ওয়ালিদ আবু আল-খায়েরের কারাদণ্ড, পাশাপাশি তার ভাই ব্লগার রাইফ বদাওয়ির কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, আমেরিকান বার অ্যাসোসিয়েশন সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০০৮ সালে সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য সৌদি সরকার এসসিসি তৈরি করেছিল। তবে বাস্তবিক চিত্র হল রাজনৈতিক অসন্তুষ্টি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং মানবাধিকারকর্মীদের সন্ত্রাসবাদী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের বিচার করা হয় এই আদালতে। এসসিসি নামের বিশেষায়িত ওই ফৌজদারি আদালতটি নিয়মিত কোনও প্রমাণ ছাড়াই সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করে।’
তামারা কিবলাওয়ি সিএনএনের সিনিয়র মিডিয়া প্রডিওসার