সবুজ আন্দোলন, সবুজ তরঙ্গ
সবুজ রুমাল হলো গর্ভপাত আন্দোলনের প্রতীক। আর্জেন্টিনায় গর্ভপাত বৈধ হওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সবুজ রুমালে মুখ ঢাকা আন্দোলন সারাবিশ্বের নারীবাদীদের আন্দোলিত করেছে। হ্যা, নারীবাদী ও অধিকার কর্মীদের আন্দোলন চূড়ান্ত সফলতা এনেছে। তবে পূর্ণাঙ্গ আইনি বৈধতা না হওয়া পর্যন্ত গর্ভপাত এখনও সেদেশের ‘ক্রিমিনাল কোড ১৯২১’ আইনের ৮৬ ধারার ফৌজদারি অপরাধের নিষিদ্ধতার চাদরেই ঢাকা থাকছে।
গর্ভপাত বৈধকরণ বিল শুধু গর্ভপাতকেই বৈধ করছে না। এটি আসলে আমাদের ‘জন্মদায়ী মেশিন’ হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত করবে
আর্জেন্টিনার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও নারীবাদী লেখক গ্যাব্রিয়েলা ক্যাবেজান চামারা বলেছেন, গর্ভপাত বৈধকরণ বিল শুধু গর্ভপাতকেই বৈধ করছে না। এটি আসলে আমাদের ‘জন্মদায়ী মেশিন’ হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত করবে। নারী নিজের দেহ এবং ও দেহের গন্তব্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কেবল নারীরই থাকবে।
যদিও ১৯ শতকের নারীবাদীরা গর্ভপাতের বিষয়টিকে পুরুষকে দায়মুক্তি দেওয়া বলে বিবেচনা করেছেন। ফলে তারা গর্ভপাতের অধিকারের বিপরীতেই নিজেদের সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অ্যালিজাবেথ ক্যাডি ও সুজান বি। যুক্তরাজ্যের মেরিস্টোপস ও যুক্তরাষ্ট্রের মার্গারেট স্যাঙ্গার গর্ভপাতের চেয়ে গর্ভনিরোধক বিষয়ে বেশি মনোযোগী ছিলেন। তারা নারীকে মূল উদ্ভিদ ও পুরুষকে আগাছারুপে দেখেছিলেন। গর্ভপাত যেহেতু নারীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তাই তারা মত দিয়েছিলেন, আগাছা পরিস্কার করা যায় মূল উদ্ভিদকে কেটে ফেলা যায় না।
সবুজ আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক নারী বলেছেন, ‘ধরুন মেয়েটির নাম ইভানা। এটি তার আসল নাম নয়। তবে ঘটনাটা আসল । তিনি আইনি অনুমতি নিয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রিপোর্ট করেছে। তবুও ভ্রুণ হত্যার দায়ে তার আট বছরের জেল হল। ২০১৭ অব্দি তিনি জেলেই ছিলেন।পরে একজন নারীবাদী আইনজীবী তার মামলাটি নিয়েছিলেন ও শেষ পর্যন্ত তিনি সুপ্রিম কোর্টকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ইভানা আইনি প্রক্রিয়া সেরেই গর্ভপাত করিয়েছিলেন।’
আর্জেন্টিনার লেখক ক্লাউডিয়া পাইসেইরো বলেছেন, আমি আইনি গর্ভপাতের জন্য প্রচারণা চালিয়ে বহু বছর ব্যয় করেছি। শেষ পর্যন্ত এটি সফলকাম হচ্ছে।
আর্জেন্টাইন নারীবাদীরা বলেছিলেন—‘লা লুচা এস্তে এন লা কল , মানে হল যুদ্ধটি এখন রাস্তায়। নারীর আন্দোলন এখন সড়কে প্লাবিত হবে। দুই বছর আগে, গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে ঠিক এমনই নাটকীয় বিতর্কে পড়েছিল আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার গর্ভপাত বৈধকরণ বিলকে কংগ্রেসের নিচের হাউজ অনুমোদন দিলেও সিনেটে সেটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।’
এরপর থেকে মুখে সবুজ রুমাল পেচিয়ে আন্দোলনকারীরা সড়কে অবস্থান নিয়েছিলেন। গর্ভপাত অধিকারের পক্ষের বিক্ষোভকারীরা আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে কংগ্রেস ভবনের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছে এবং সেখানেই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সবুজ আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারীরা বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসের লকডাউনে নারীদের স্বাস্থ্য আরও ঝুঁকিতে। গর্ভপাত অবৈধ হওয়ায় গোপন গর্ভপাতের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বেড়েছে। নারীদের স্বাস্থ্যসেবা পেতে আরও বেশি বেগ পেতে হচ্ছে।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদন দেখিয়েছে,আর্জেন্টিনার ২৩টি প্রদেশের মধ্যে ৫টি আইনি গর্ভপাত অ্যাক্সেসের জন্য কোন ব্যবস্থাই প্রণয়ন করেনি। ফলে ওইসব প্রদেশে নারীদের জন্য আইনিভাবে মোকাবেলা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে করোনাভাইরাসের লকডাউনে নারীরা ক্রিমিনাল কোডের ৮৬ ধারার নিষিদ্ধতা ও আইনি বাধার সম্মুখীন হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও একজন অল্পবয়সী কিশোরীর সাক্ষাতকার নিয়েছিল যারা গর্ভপাতের অনুমতি নিতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল। কিন্তু কঠোর আইন ও অনুমতি নেওয়ার পথটি বড়ই দুর্গম। বলাই বাহুল্য অনুমতি নেওয়ার প্রক্রিয়ার জটিলতায় তারা সফল হয়নি।
ওই নারীরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানায়, একদিকে সামাজিকভাবে চরিত্রে কলঙ্ক লেপন অন্যদিকে দুর্গম আইন তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।
আর্জেন্টাইন সংস্থা ‘অ্যাক্সেস টু সেফ অ্যাবরশন’ বলছে, আর্জেন্টিনায় ১২ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীরাও মা হয়। সেটি ঘটে ধর্ষণের ফলে।
প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীরা ক্রিমিনাল কোডের বিধানের অধীনে গর্ভপাত চেয়েছিলেন। তাদের বেশিরভাগই আইনি গর্ভপাতের আবেদন করার সময় দীর্ঘ বিলম্বের শিকার হন। অন্যদিকে চিকিৎসকদের আইন সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় এবং আইনি শাস্তির ভয়ের কারণে তারা বিচারিক অনুমোদন ছাড়া সেটি করতে চান না।
উল্লেখ্য, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে গর্ভপাত অবৈধ। অনাগত শিশুরও জীবনের অধিকার আছে এছাড়াও এটি বেশিরভাগ ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীতে যায়। আর্জেন্টিনায় ইচ্ছেকৃত গর্ভপাতকে জীবন ও মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়। যে ব্যক্তি গর্ভপাত ঘটায় তাকে ১-১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যায়। একই শাস্তি পাবে গর্ভপাতে সাহায্যকারী চিকিৎসক,সার্জন, মিডওয়াইফ বা ফার্মাসিস্টরাও। এছাড়াও যে নারী ইচ্ছাকৃতভাবে তার নিজের গর্ভপাত ঘটায় বা অন্য কোনও ব্যক্তির সাথে সেটি করার সম্মতি দেয় তাকে ১-৪ বছরের জন্য কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হয়। তবে চিকিৎসক নারীর জীবন বিপন্ন অবস্থায় ও ধর্ষণের ফলে গর্ভধারণের ক্ষেত্রে গর্ভপাত করানোর অনুপতি পেয়ে থাকেন। আইন করে গর্ভপাত ঠেকানো গেছে বিষয়টি তা নয়। বরং আইনি প্রতিরোধের কারণে অনিরাপদভাবে গর্ভপাত করতে গিয়ে অনেক নারীর মৃত্যু হয়েছে আবার অনেক সদ্য কিশোরীকে মা হতে হয়েছে। জটিলতাটা সেখানেই।গোপন গর্ভপাতকে বন্ধ করতে হলে গর্ভপাত বৈধ করতে হবে। এ বছরের মার্চ মাসে আর্জেন্টিনা একটি ভাল সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে ছিল কিন্তু সেটি করোনাভাইরাসের ছুঁতোয় তা আলোর মুখ দেখেনি।