নেটফ্লিক্সে দেখছিলাম ব্ল্যাক মিরর সিরিজের ‘জোন ইজ অফুল’ এপিসোড, এ সালমা হায়েক অভিনীত ওই সিরিজে সি.জিআই (কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি) ব্যবহার করে একজনের ফোন থেকে সমস্ত তথ্য নিয়ে তার পুরো জীবন তছনছ করে দেওয়া হয়। ভিকটিম আইনজীবীর কাছে গিয়ে দেখতে পায়—সে যখনই স্ট্রিমিং সাইটে টার্মস এন্ড কন্ডিশনে এক্সেপ্ট বাটন ক্লিক করেছে তখন তার সব তথ্য নেওয়ার ও ব্যবহারের অধিকার পেয়ে গেছে সেই স্ট্রিমিং সাইটটি। অনলাইন অথবা অফলাইন কোন অপরাধই এখন আর সাইবার দুনিয়ার বাইরে নয়।প্রত্যেকটি অপরাধ এখন অনলাইনের সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত।
এরমধ্যে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট (ডিএসএ) ২০১৮ এর সংশোধন,পরিমার্জন ও পরিবর্তন হয়ে ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০২৩’ সেপ্টেম্বরে সংসদে উত্থাপিত হবে।
এক নজরে যেসব ধারা পরিবর্তিত হবে তা হলো-
১. ধারা ২১-এ কোন ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ,মুক্তিযুদ্ধের চেতনা,জাতির পিতা,পতাকা ইত্যাদি নিয়ে কোন বিষোদগার বা প্রোপাগান্ডা চালালে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল। এই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা ছিল দ্বিগুণ। প্রস্তাবিত সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে সাজা কমিয়ে করা হয়েছে ৭ বছর,দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলেও সাজা দ্বিগুণ হবে না।
২. ধারা ৪৩-এ পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের যে বিধান ছিলো তা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টেও বলবৎ থাকছে।
৩. ধারা ২৮,২৯,৩০- সংশোধন করা হয়েছে। এসব ধারায় কেউ অপরাধ করলে তা ছিল অজামিনযোগ্য। প্রস্তাবিত সংশোধনে-
ক. ধারা ২৮-এ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বিষয়ক ধারাটি প্রস্তাবিত সংশোধন আইন ‘সাইবার সিকিউরিটি এক্ট (সিএসএ) তে জামিনযোগ্য হচ্ছে।
খ. ধারা ২৯-এ মানহানি মামলা। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এ ক্ষেত্রে শুধু জরিমানা রাখা হয়েছে,কারাদণ্ডের বিধান রদ করা হয়েছে। এই ধারায় এখন আর কাউকে গ্রেফতারও করা যাবে না।
৩. ধারা ৩১-এ হ্যাকিংয়ের অপরাধে ৭ বছরের জায়গায় ৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
৪. ধারা ৩২-এ সরকারী গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধে সাজা ১৪ বছরের পরিবর্তে ৭ বছর করা হয়েছে।
৫. ৩৩ ধারাটি পুরোপুরি বাতিল করে হ্যাকিং এর ধারা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
মূল বিষয় হল— ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাকট (ডিএসএ) বাতিল হচ্ছে না বরং পরিবর্তিত নামে আসছে আরেকটু বড় পরিসরে। প্রতিদিন অপরাধের ধরন বদলে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্য,যুক্তরাষ্ট্র,ভারত যেসব দেশের দিকেই তাকাই সব দেশেই নানা নামে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট,ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট,সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ইত্যাদি আছে।
আমাদের দেশে সাংবাদিকসহ অন্য ব্যক্তিরা কেন ডিএসএ’র বিরুদ্ধে এত সোচ্চার ছিলেন?এবং আছেন?
এর কারণ হল আইনের অপপ্রয়োগ। আমরা উদাহরণস্বরূপ একের পর এক ঘটে যাওয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত হামলার প্যাটার্ন যদি দেখি সেখানে দেখব সংখ্যাগরিষ্ঠ কেউ সংখ্যালঘুর নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট করে ধর্মীয় অবমাননার পোস্ট দিয়ে এক একটি এলাকার সংখ্যালঘুদের জান-মাল সব বিপন্ন করে দিয়েছে। ব্লাসফেমির মতো একটি মধ্যযুগীয় বিষয় ডিএসএ’র অধীনে মামলা করার ক্ষেত্রে নির্বিচারে ব্যবহার করা হয়েছে।
একের পর এক সাংবাদিক এই ডিএসএ’র আওতায় শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন। রাষ্ট্রে যখন কোন অন্যায় চলে তখন সেই অন্যায়কারীরা কি তাদের তথ্য সাংবাদিকদের হাতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তুলে দেবেন? না তো। সাংবাদিকরা নানা সোর্স থেকে তা সংগ্রহ করে গণমানুষের কাছে উন্মোচিত করবেন এটাই স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিক পেশাগত কাজ করতে গিয়ে সংক্ষুব্ধ কারও সাথে আইনি লড়াই এক কথা কিন্তু কোন রকম পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার হয়ে যাওয়া ও জামিন না পাওয়া ডিএসএ’র কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদিজাতুল কুবরা আজকে প্রায় ১০ মাস ধরে কারাগারে ডিএসএ’র মামলায়। অথচ ডিএসএ’র মামলা সর্বোচ্চ ১৮০ দিনে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা,যদি না হয় তার সাথে সর্বোচ্চ ৯০ দিন সময় বর্ধিত করা যায়। খাদিজাতুল কুবরার মতো অনেক প্রাপ্তবয়স্ক অপ্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এই নিবর্তনমূলক আইনের শিকার যা প্রথমেই বলা হয়েছে সরকারি হিসেবেই গত ৫ বছরে দায়ের হয়েছে ৭১০০ টি মামলা ।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা যে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তা হলো বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ (ইন্টারন্যাশনাল কভনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস) আইসিসিপিআরের স্বাক্ষরদাতা হিসেবে ওই সনদের অঙ্গীকারগুলো লঙ্ঘন করতে পারে না। ওই সনদ রাষ্ট্রপ্রধানসহ সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগকারী এবং অন্য সব জনব্যক্তিত্বকে সমালোচনা করার অধিকার দিয়েছে। এছাড়া সমালোচিত ব্যক্তির পরিচয় শাস্তির মাত্রা নির্ধারণের ভিত্তি হতে পারে না। ঐতিহাসিক তথ্য সম্পর্কে মতামত প্রকাশের প্রশ্নে শাস্তিমূলক আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে লঙ্ঘন করে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রশ্নে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধিটি আইসিসিপিআরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, কারণ কোনো ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা যদি বৈষম্য, বৈরিতা বা সহিংসতায় উসকানির পর্যায়ে উপনীত না হয়, তাহলে তা অপরাধ নয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের অনানুপাতিক হারে বেশি হেনস্তা হওয়ার অভিযোগও সম্প্রতি জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে।
ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে আমাদের ডিএসএ অ্যাক্টকে যত জোরালো দেখা যায় ততটা তোড়জোড় কিন্তু নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভরাহাটে প্রকাশ পেয়ে গেলে দেখা যায় না। সম্প্রতি লাখ লাখ মানুষের এনআইডির তথ্য সাইবারস্পেসে খোলা অবস্থায় পাওয়ার পরও আমরা কিন্তু এ নিয়ে কোন তড়িৎ তৎপরতা দেখতে পাই না।
আইন সব সময় মানুষকে বাঁচানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে। যে আইনই নিপীড়ন ও দমনের উদ্দেশ্যে তৈরী হয়েছে তা কখনও মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনেনি।
শোকের মাস আগস্টে আমাদের ইন্ডেমনিটি আইনের কথা মনে পড়ে-সেই আইন কিন্তু বাতিল করতে হয়েছে স্বজন হারানোদের সঠিক বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে। তেমনি সাইবার স্পেসে ঘটা নানা অপরাধ যেমন ব্যাংকিং চ্যানেলের অর্থ হ্যাংকিং এর মাধ্যমে ট্রান্সফার,কারও ন্যুড ছড়ানো,হুমকি,আপত্তিকর ভিডিও,ব্ল্যাকমেইলিং,ডার্ক ওয়েব সংশ্লিষ্ট অপরাধ,ডিজিটাল চৌর্যবৃত্তি,ড্রাগের লেনদেন,আইডেনটিটি থেফট ইত্যাদি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাইবার সিকিউরিটি এক্ট জোরেশোরে কাজ করুক।
নাগরিক নিপীড়নের হাতিয়ার,বিরুদ্ধমত চাপা দেয়ার কাজে আইনের অপপ্রয়োগ না ঘটুক। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে একজন জুলিয়ান এসাঞ্জ ছিলেন বলে উইকিলিকস এর আড়াই লক্ষ নথির মাধ্যমে দুনিয়া জেনেছে গুয়াতানামো বে কারাগারের কথা,জেনেছে আমেরিকা কিভাবে ইরানকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে,কিভাবে সোমালীয় বিদ্রোহীরা রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাতের মারার পরিকল্পনা করেছে।
অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে আমাদের কাজ বড়জোর ফ্যাক্ট চেকিং এর ও ইন্সটিটিউট অনুযায়ী সাইবার কোড অব কন্ডাক্ট কী হবে সে নির্দেশনা দেওয়ার। কারও কণ্ঠ রোধ করে কালা কানুন তৈরি সভ্যতার পরিপন্থী একটি কাজ। তাই যে আগস্টের কারণে ইন্ডেমনিটি বিল রহিত হয়েছে সেই আগস্টেই ডিএসএ’র ২১ ও ২৮ ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যুগোপযোগী সাইবার সিকিউরিটি এক্ট দেশের নাগরিকদের জন্য তৈরি হবে,এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: অর্পিতা চৌধুরী (আইনজীবী, সুপ্রিমকোর্ট)