সুফিয়ার গল্পগুলো আমি জানি। কিন্তু গুছিয়ে বলতে পারব না। আমি গল্পকার নই। কিভাবে বললে শ্রোতারা মন দিয়ে শোনে সেই আর্ট জানা নেই। কোন অংশটি আগে বললে কাহিনির বাকিটা শুনতে মানুষ আকুল হবে জানি না। কোথায় গল্পের ক্লাইমেক্স, কোন জায়গা থেকে পাঠককে ফিরিয়ে আনতে হয়, বাঁক বদলে কিভাবে গল্পের নতুন বাস্তবতায় পাঠককে নিয়ে যেতে হয়, কিভাবে হাসাতে হয়, কাঁদাতে হয় বা উদাস আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলার অবকাশ পাঠককে দিতে হয় তা আমার জানা নেই।
আমি একজন পাঠক। জীবনকে পাঠ করতে জানি। আর জানি প্রশ্ন করতে। জীবনের গল্পগুলো এমন কেন – তা নিয়ে প্রশ্ন করি। কাহিনিটি ওরকম না হয়ে যদি এমন হতো? কাহিনিটি ঢাকা শহরের না হয়ে যদি গ্রামের হতো? মুসলমানের না হয়ে যদি হিন্দুর হতো? বাংলাদেশের না হয়ে যদি সৌদি আরবের হতো, যদি তুরস্কের অথবা ইতালির হতো? কাহিনিটি গরীবের না হয়ে যদি ধনী পরিবারের হতো? এসব প্রশ্ন মাথায় আসে। সর্বোপরি কাহিনিটি সুফিয়ার না হয়ে যদি তার স্বামী আলমের হতো?
চার বছর হলো আলম আরেক মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে; যখন সুফিয়ার বয়স ২৭ বছর। তার দেহের বর্ণনা দেব না। শুধু বলছি, সে শারীরিকভাবে সক্ষম একজন আকর্ষণীয় নারী। যদিও তার মধ্যে আকর্ষণীয়তার অন্য দিকগুলো নেই। লেখাপড়া তেমন নেই, মার্জিত ভাষা নেই, সুন্দর করে বলার আর্ট নেই, পরিশিলিত সংস্কৃতি নেই। এমনিতেই অবনত মস্তকা বাঙালি নারী মনে হলেও খটখটে কথা বলতে তার বাঁধে না।
একদিন বলেছিল, তাকে নাকি সবাই চায়, বিছানায় চায়। আলম পালানোর পর থেকে কতো মানুষ যে চেয়েছে!
প্রশ্ন করা আমার অভ্যাস। সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনকে প্রশ্ন করেছিলাম, আচ্ছা সুফিয়া নিজে কেন চায় না? নারীর শরীরে কি যৌনতা সব সময় অবচেতন থাকে? পুরুষ তার যৌন চেতনা জাগিয়ে না তুললে সে কি নিজে থেকে জাগে না? এই যে সুফিয়াকে হাজার পুরুষ চেয়েছে, সুফিয়ার সুপ্ত আকাঙ্খা তখনো কি জাগেনি? তাহলে সুফিয়া ’না’ করে দেয় কেন? না কি সুফিয়ারা ছেলেদের মতোই মনে মনে আকাঙ্ক্ষায় অধীর থাকে? শাস্ত্র তো বলছে, “পুরুষকে দর্শনমাত্র স্ত্রীদের উহার সহিত ক্রীড়ার ইচ্ছা জন্মে।”
[পৌংশ্চল্যাচ্চলচিত্তাচ্চ নৈঃস্নেহ্যাচ্চ স্বভাবতঃ।
রক্ষতা যত্নতোহপীহ ভর্তৃস্বেতা বিকুর্ব্বতে।। মনু ৯/১৫]
এমনকি সবসময়ের জন্য সক্রিয় পাহারাদার একজন স্বামী থাকা সত্ত্বেও ফাঁক পেলেই স্ত্রীরা নাকি অন্য পুরুষের সঙ্গে কুকর্মে লিপ্ত হয়! উপরোক্ত শ্লোকে নারীর মনোস্তত্ত্ব সম্পর্কে মনু এরকমই বলে গেছেন।
“স্ত্রীরা সৌন্দর্য্য অন্বেষণ করে না। যুবা বা বৃদ্ধ ইহাও দেখে না। সুরূপ বা কুরূপ হউক, পুরুষ পাইলেই উহার সহিত সম্ভোগ করে।”
[নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্থিতিঃ।
সুরূপম্বা বিরূপম্বা পুমানিত্যেব ভুঞ্জতে।। মনু ৯/১৪]
তবে যে আমার বন্ধুরা বলেন, মেয়েদেরকে প্রলুব্ধ করে তৈরি করতে না পারলে তারা নাকি সহজে রাজি হয় না? এমন কি, নারীর নাকি বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না!
আচ্ছা মানলাম, নারীর চরিত্র এমনই। কিন্তু পুরুষরা যে ফুটো পেলেই ঢোকাতে চায়? মাদ্রাসাগুলি থেকে যে গল্প মিডিয়ায় বের হচ্ছে ….! মাদ্রাসার বাইরে কি এমন কোনো কাহিনি নেই?
সুফিয়াদের মনোজগত আসলে কেমন? এ বিষয়ে কোরআন-হাদিসের মতামত কি, মুসলিম স্কলাররা কিভাবে বিষয়গুলো দেখেছেন, বাইবেল কি বলছে, পাশ্চাত্যের দার্শনিক ও মনোদৈহিক বিজ্ঞানিরা কি বলেন ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। তবে বলে রাখি প্রশ্ন করা আমার অভ্যাস। এরকমই একজন সুফিয়ার জীবন ইউরোপে হলে কেমন হতো, আফ্রিকায় বা ল্যাটিন আমেরিকায় হলে কেমন হতো, সৌদি আরবের অথবা ইরানের হলে কেমন হতো, মাতৃতান্ত্রিক সমাজে কেমন হতো, বাংলাদেশের গ্রামে হলে কেমন হয়, ইটপাথরের নগরীতে কোটি মানুষের ভীরে কেমন – এ রকম সব প্রশ্ন প্রতি মুহুর্তে আপনাদের মনেও জাগলে সিদ্ধান্তগুলি ‘আপাতঃ দৃষ্টি নির্ভর’ বা ’বিশ্বাস নির্ভর’ হতো না।
সুফিয়ার কথায় আসি। জানতে চেয়েছিলাম, আলম চলে গেল কেন?
‘যে লোকের গাড়ি চালাইত, তার বাড়িতে কাজ করা এক বেটিকে নিয়া ভাগছে।’
অনেক দিন তো হয়ে গেল। তুমি বিয়া করলে না কেন?
দুইটা বাচ্চা আছে যে!
কেন, বাচ্চা থাকলে কি বিয়া করা যায় না?
যায়; কেউ কেউ বিয়া করতে চাইছেও। বাচ্চা ছাড়া যাইতে কয়।
বাচ্চাসহ যদি কেউ নিতে চায়? বিয়া করবা?
না গো ভাই; অনেক দেখছি। আরও খারাপ হয়। কত মাইয়ার অবস্থা দেখলাম! পুরুষ জাতি চেনা হয়ে গেছে।
এরপরই সেই ডায়লগটা দিয়েছিল। “সবাই খালি লাগাইতে চায়। আলম পালানোর পর থাকি কতো মানুষ চাইছে!”
বলেছিল, ‘ঐগুলা বাদ। এখন একটাই চিন্তা – বাচ্চা দুইটাকে খাওয়াতে হবে, মানুষ করতে হবে।’
সুফিয়া তার ছেলেটাকে মাদ্রাসায় দিয়েছে। মেয়েটি ছোট – এখন তার নানীর কাছে থাকে।
অভ্যাস বসত আবারও মনে প্রশ্ন জাগছে। সুফিয়া মুসলিম নারী। দুই সন্তান থাকা সত্ত্বেও সে চাইলে বিয়ে করতে পারে। তাতে তার পরবর্তী জীবন সুখের হবে, নাকি দু:খের হবে – সে ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু সুফিয়াকে বিয়ে করতে কার্পণ্য করবে না – বাঙালি মুসলমান সমাজে এমন পুরুষের অভাব নেই। আলমের কাছ থেকে আইনগতপন্থায় তালাক নিতেও সুফিয়ার বাধা নেই। কিন্তু স্বামী পরিত্যক্তা এই নারীটি যদি সুফিয়া না হয়ে শেফালি রাণী হতো?
শেফালিদের ডিভোর্স পাওয়ার অধিকার নেই, পিতামাতার সম্পত্তিতেও অধিকার নেই।
আল্লামা আহমদ শফি বলেছিলেন, পুরুষের কাছে মেয়েরা তেতুলের মতো। অর্থাৎ তারা মানুষ নয়, লোভনীয় বস্তু বিশেষ। তাকে বস্তু হিসেবেই সিন্দুকে ভরে রাখতে হবে। থ্রি, ফোরের বেশি পড়াশোনা করতে দেওয়া যাবে না।
এ কথায় আমরা শাহবাগিরা সবাই ক্ষেপে গিয়েছিলাম। কিন্তু নারী যে মানুষ নয়, বস্তুমাত্র – এ কথা প্রায় সকল ধর্মেই প্রমাণিত সত্য – ধর্ম নিজে যদি আদৌ কোনো ’প্রমাণিত সত্য’ হয়ে থাকে!
নারীরা আসলে কি, সে বিষয়ে আমি শত শত শাস্ত্রবাণী দেখাতে পারব। নারী দানের পণ্য, নারী ভোগ্যবস্তু, তার সম্পত্তিতে সমঅধিকার নেই, তাকে পুরুষের অধীনে থাকতে হবে, তাকে যৌনদাসী বানানো অন্যায় নয়, তার মালিক হওয়া যায়, অন্ত:পুরে থাকা অথবা মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত নিজেকে ঢেকে রাখা তার দায়িত্ব। এক সময় তার ভোটাধিকারও ছিল না। শাস্ত্রবাক্যে এবং প্রকৃত জীবনে এই প্রয়োগ। এই আধুনিক যুগেও এগুলো প্রায়োগিক সত্য।
মানুষ দাসত্ব মেনে নেয় এবং একজন দাসকে বেঁধে রাখার কাজটি করে আরেকজন দাস। মালিক নিরাপদে ভোগ করে। দাসরা শিখে নেয়, “নুন খাই যার, গুণ গাই তার।” এভাবেই অতীতের দাসপ্রথা টিকে ছিল, এভাবেই বর্তমান সমাজ টিকে আছে।
সুফিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল শান্তা আপার চেম্বারে। শান্তা আপা ডাক্তার। বাচ্চা অ্যাবরশন করতে তার কাছে গিয়েছিল সুফিয়া। অপ্রত্যাশিত গর্ভ ফেলে দিতে চায়!
আচ্ছা, মায়ের গর্ভে থাকতেই একজন মানবশিশু কিভাবে অপ্রত্যাশিত হয়? আবারও মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। সে সব আর বাড়াই না। সুফিয়া অপারেশন করে নিজেকে বন্ধ্যা বানিয়ে নিয়েছে। এখন সে স্বাধীনভাবে ঢাকার ফকিরাপুলে বিভিন্ন মেসে কাজ করে।
কি ভাই? প্রথমে তাকে সতী নারী ভেবেছিলেন? তাকে যৌন দুর্গন্ধহীন নিরামিষ ভোজী ভেবেছিলেন? গরীবের মেয়েটির প্রতি মনে মনে শ্রদ্ধাও জন্মেছিল? এবার সব শ্রদ্ধা চলে গেল? আচ্ছা, যৌনতা আপনার নিজের কাছে আসলেই কি দুর্গন্ধময়?
সুফিয়ার এই যে জীবন, সেটা কি নিছক যৌন জীবন? নাকি এ এক অর্থনীতির গল্প? তার কাছে যৌনতা কি শুধুই দৈহিক চাহিদা? না-কি এর মধ্যেই রয়েছে তার বেঁচে থাকা এবং দুই সন্তানের ভরণপোষণের ব্যবস্থা? সে একটি অর্থনীতির উপাদান নয় কি? যে জিনিস গোপনে লুকিয়ে রেখেও পার পাওয়া যায় না, তা সে বিক্রি করে দেয়। যে জিনিসের চাহিদা আছে এবং বিক্রয়মূল্য রয়েছে, বাজার অর্থনীতিতে তারই সরবরাহ ঘটছে।
আপনারা এতক্ষণে জেনে গেছেন সুফিয়া বেশ্যা, বাজে মেয়ে! কি ভাই, আপনি নিজে কি বেশ্যা নন? সুফিয়া বলেছিল, পুরুষ মানুষকে তার চেনা হয়ে গেছে। আর কি বলেছিল জানেন? সে বলেছিল, ”পুরুষ মানুষ গু খাওয়া জাতি।”
লেখক: সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্ট