নারীর সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার এবং একটি প্রেমময় দাম্পত্য সম্পর্ক যেন একটা বিপরীতার্থক শব্দ। সম্প্রতি ঢাবির মেধাবী শিক্ষার্থী সুমাইয়া হত্যাকাণ্ড পুরো দেশকে দেখালো পুরুষের নিয়ন্ত্রণকামী মনোভাব কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। খুব দুঃখজনক কিন্তু এটাই বাস্তবতা—বিশ্বের অনেক দেশেই নারীর ক্যারিয়ার সাফল্য তাদের দাম্পত্যে বাধার সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি সুইডেনভিত্তিক একটি গবেষণা দেখালো, নারীর সফল কর্মজীবনের জন্য ব্যক্তিজীবনে তাদের উচ্চমূল্য শোধ করতে হয়েছে।
গবেষণাটি বলেছে— সুইডেনে রাজনীতি বা ব্যবসায়ের শীর্ষস্থানীয় পদে পদোন্নতি প্রাপ্তির ফলে নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের হার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে এমন কিছুই ঘটছে না!
সুইডেনে গত ৩০ বছরে নারীর উচ্চশিক্ষার হার পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছে এবং তাদের শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ প্রায় একই স্তরে পৌঁছেছে। আজকাল সেখানে মহিলা সিইও, কর্পোরেট বোর্ডের সদস্য এবং শীর্ষ পর্যায়ের সংসদ সদস্যদের অনুপাত সর্বোচ্চ। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মতো , সুইডেনে সফল ক্যারিয়ারসমৃদ্ধ মহিলাদের বিচ্ছেদের মতো দুঃখজনক ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
গবেষণা দেখিয়েছে—সুইডিস পুরুষেরা তাদের তুলনায় স্ত্রীদের উচ্চতর ক্যারিয়ার মেনে নিতে পারছেন না!
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখুন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে পাশ করা সুমাইয়াকে শ্বশুরবাড়ির লোকের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে কেবল সে পড়াশোনা ও চাকরির প্রতি আগ্রহের কারণেই। ঢাবির শিক্ষক বা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার বদলে শ্বশুরবাড়ি নাটোরের হরিশপুর বাগানবাড়িতে লাশ হল সুমাইয়া।
এমন নয় যে সুমাইয়ার স্বামী খুব সংসারী। তার স্বামী মোস্তাক বিয়ের আগে একটি চাকরি করলেও বিয়ের পর সে পুরোদস্তুর বেকার ও কপর্দকশূন্য। মেয়েটির বাবার পরিবারই তার সমস্ত খরচ বহন করত। শুধু তাই নয় জোর করে গর্ভপাত করিয়েছে স্বামী মোস্তাক। সংবাদটি পড়লেই স্পষ্ট ধারণা পাবেন যে স্ত্রীর সফলতা সহ্য করতে পারছিল না হিংসুটে স্বামী ও তার পরিবার। জানিনা কত সুমাইযা ডুকরে কাঁদে, কত সুমাইয়া বিয়ে করে শত্রু হওয়া স্বামীর জাল ছিড়ে বের হতে পেরেছে।
নারীর ক্যারিয়ারে স্বামীর বাধা কেন?
বাংলাদেশে আগের তুলনায় নারীর জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। কিছু সময় এমনি বদলে দিয়েছে। কিছু পরিবর্তন পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে স্ত্রী নির্বাচনের জন্য তারা স্নাতক পাশ করা মেয়ে চান, মেধাবী চান, চাকরিজীবীও চান। পরে তার বাড়তি যোগ্যতাটুকু কাল হয়ে দাঁড়ায় নারীর জন্য। থামিয়ে দিতে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চলে এদেশের অধিকাংশ নারীর উপরই।
নারীর যোগ্যতাকে মেনে নিতে পারেনি স্বামীদের পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব। যোগ্যতাসম্পন্না নারীর আত্মসম্মানটুকুকে মেনে নেওয়া শ্রদ্ধা করা তাদের জন্য কঠিন একটি কাজ।
এ কারণেই নারীর লাগাম টানতে তার অনেক সক্রিয়।
কী বলছে পুরুষের মনস্তত্ত্ব ?
অশিক্ষিত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নয় উচ্চশিক্ষিত পুরুষরাই নারী নির্যাতনের সাথে বেশি জড়িত। তারা মনে করেন স্ত্রীর ক্যারিয়ার তার চাইতে ওপরে হলে হয়তো স্ত্রী তাকে মানবেন না। মানানোর বা নিয়ন্ত্রণ করার মনস্তত্ত্ব থেকে তারা বের হতে পারেনি।
কিছু পুরুষ দেখান খোঁড়া যুক্তি—নারী স্বাবলম্বী হলে সন্তান জন্মদানে অনাগ্রহী হবে, স্বাবলম্বী নারী সংসারের কাজে সময় দেবে না। বাবা-মা উভয়েই কর্মক্ষেত্রে থাকলে সন্তানের লালন-পালন ঠিকভাবে হবে না। কিন্তু তাদের অন্তরাত্মা কাঁপে নারীর আত্মসম্মান ও সাবলীল মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে ভেবে। অনেক পুরুষই তার নিয়ন্ত্রণকামী মনকে বলতে চান প্রোটেকটিভ ও ভালোবাসা হিসেবে। এমনকী আইনত যা নির্যাতন সেটিকেও তারা নিজেদের অধিকারভুক্ত একটা কাজ ভেবে বসে। নিজের সিদ্ধান্ত জোর করে স্ত্রীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত হওয়াকে তারা ভয় পায়। একচ্ছত্র ক্ষমতা আর আধিপত্য হারানোর ভয়ে ভীত থাকে হীনম্মণ্য পুরুষ। সবচেয়ে ভয়ানক হল- পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এ নিয়ন্ত্রণকামীতাকে তোষণ করে ও বাঁচিয়ে রাখতে চায়।
কী হওয়া উচিত?
স্ত্রীকে প্রতিযোগী না ভেবে যদি সংসারের একজন একটিভ সদস্য ভাবত, তার সহযোগী ভাবত- লাভটা পুরুষেরও হত। সাফল্য বাড়ত। সম্মান বাড়ত। পেশাজীবন ও ব্যক্তি জীবন সামাল দিয়ে চলাটা শিখতে হবে পুরুষকেও।
‘নারী যত পড়ালেখাই করুক না কেন ঘরই হবে তার মূল প্রায়োরিটি’- এই চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে পুরুষের। নারী যখন বাচ্চা নেওয়ার পরেও চাকরি করে বা ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগী হয় সেটি ‘অপরাধ’ নয় ওই নারীর যোগ্যতা।