আইনি লড়াই লড়েই সন্তানের একক অভিভাকত্ব পেলেন ফারজানা
তালাকের পর চার বছর পর স্ত্রীকে হয়রানি করতে ছেলে সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০০ ধারার অধীনে মামলা দায়ের করেছিলেন স্বামী। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে গতকাল বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১) সোলেনামা চুক্তির মাধ্যমে একক অভিভাবকত্ব পেয়েছেন সন্তানের মা ফারজানা সিরাজ শীলা। ফারজানা নিজেও একজন মানবাধিকার ও সমাজকর্মী।
জানা যায়, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে স্বামীকে তিনি আইনিভাবে তালাক দিয়েছিলেন ২০১৫ সালে। ওই সময় স্বামী তাকে বিয়ের কাবিনের টাকা, ভরণপোষণ এমনকী সন্তানের জন্যও কোনরকম ভরণপোষণের টাকা দেননি। ছেলে বড় হচ্ছিল মায়ের আর্থিক দায়িত্ব ও তত্ত্বাবধানে। পরে স্ত্রী যখন দ্বিতীয় বিয়ে করেন চার বছর পর হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসলেন তার প্রাক্তন স্বামী ইসতিয়াক হোসেন।
তালাকের প্রায় চার বছর পর এসে স্ত্রী নিজের সন্তানকে অপহরণ করেছেন ও স্ত্রীর কাছে সন্তানের জীবন বিপণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে ও সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করে ফারজানা সিরাজের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০০ ধারার অধীনে চুয়াডাঙ্গার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা দায়ের করেছিলেন তার প্রাক্তন স্বামী ইসতিয়াক হোসেন।
ফারজানাকে পাঠানো সমনের কপিওই অভিযোগে বলা হয়, ‘ স্ত্রী অত্যন্ত দুর্ধর্ষ বদমেজাজী ও স্বামীর অবাধ্য। বিবাহের পর স্বামী স্ত্রীর সংসার করাকালে একটি পুত্র সন্তান হয়। স্ত্রীর আচরণ ভাল না হওয়ার কারণে ২০১৫ সালে তাদের সম্পর্ক তালাকের মাধ্যমে ছিন্ন হয়। স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করে সন্তানকে তার বর্তমান স্বামীর চাকুরিস্থল ফান্সে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেখানে সন্তানের জীবন নাশের সম্ভাবনা আছে। সে কারণেই ফৌজদারি কার্যবিধি ১০০ ধারার অধীনে সন্তানকে মায়ের জিম্মা থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে ফারজানা সিরাজ উইম্যান ভয়েসবিডিকে বলেন, ছেলেকে চার বছর আমি একাই লালন পালন করেছি। ছেলের কোন খোঁজ খবর তারা নিত না। এমন কী অসুস্থতায়ও না। আমার দ্বিতীয় বিয়ের পরে হঠাৎ করেই সন্তান দাবি করে বসে সে ও তার পরিবার। সে আসলে আমাকে হয়রানি করতে ও ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে মানসিক নির্যাতন করতেই এমনটা করে। ১০০ ধারায় চুয়াডঙ্গার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলাটি দায়েরের পর থেকেই আমি প্রচণ্ড হয়রানির শিকার হই। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক। বারবার আদালতে হাজির হওয়ার ডেট আসে। একদিকে সন্তান পালনের একার দায়িত্ব অন্যদিকে আদালতের ঝক্কি। আমি হাল ছাড়িনি।
ফারজানা বলেন, ‘আমার প্রাক্তন স্বামীর বাবা চুয়াডাঙ্গার আইনজীবী ও তার পরিবারের আরও কয়েকজন আইনজীবী ছিলেন। আদালত এলাকায় তারা অনেকটাই দাপুটে ছিল। সে ক্ষমতা ব্যবহার করে আমাকে মারাত্মকভাবে হয়রানি করে। কোন আইনজীবী আমার মামলা নিতে চাইছিলেন না। এমন কী চুয়াডাঙ্গায় ম্যজিস্ট্রেট আমাকে কোন কথা বলারও সুযোগ দেননি। বারবার হাজির হওয়ার ডেট দিতেন। মামলা দায়ের হওয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক) গেলে সেখানের একজন অফিসার আমাকে অনেকটা আনঅফিশিয়ালি বলেছিলেন আমি যেন ছেলে তাদের দিয়ে দিই।’
ফারজানা বলেন, ‘আমি বারবার তাদের মধ্যস্থতা ও আপোষের কথা বললেও তারা ক্ষান্ত হয়নি। এরপর বাধ্য হয়ে আমি ঢাকা এসে ভরণপোষণ চেয়ে মামলা দায়ের করি। ওই মামলায় আমি উল্লেখ করি যে দীর্ঘ চার বছর তিনি নিজের ছেলের জন্য কোন ভরণপোষণ বা চিকিৎসার খরচও দেয়নি। এমনকী ওই চার বছরে তারা আমার ছেলেকে দেখতেও চায়নি। হঠাৎ করেই ছেলেকে নিয়ে মামলা দায়ের করে।’
ফারজানা সিরাজ বলেন, আমি ছেলের ভরণপোষণ ও অভিভাবকত্ব চেয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করলে সেটির রায় যখন আমার পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল তারা আপোষ কেরতে চাইল। আমার প্রাক্তন স্বামীর মা ঘনঘন বাসায় এসে জানতে চান আমার যে সব বিষয়ে অনুমতি লাগবে তা তারা দিতে রাজি আছেন। পরবর্তীতে আমি ভরণপোষণ চাইব না এমন শর্তে ছেলেকে আমার জিম্মায় ও আমাকে একক অভিভাবকত্ব দিতে সম্মত হয়ে গেল। এবং সোলেনামায় উল্লেখ করা হয়েছে যে সন্তানের যেকোন বিষয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারব এবং ছেলেকে আমি সঙ্গে ফ্রান্স নিয়ে যেতেও কোন আইনি বাধা থাকল না।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা সন্তানের অভিভাবকত্ব পাওয়া একটি কঠিন যুদ্ধ জানিয়ে ফারজানা সিরাজ বলেন, আমাদের দেশে যতটুকুই বা আইন আছে নারীর জন্য। কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। এই যে আমি আইনজীবীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি তারা বেশিরভাগই আমাকে নিরাশার কথা বলেছেন। অথচ আইনে আছে সন্তানের কল্যাণের জন্য সন্তানকে মায়ের জিম্মায় দিতে পারে আদালত। এমনকী যে পিতা সন্তানের ভরণপোষণ দেয় না মা চাইলে তাকে সন্তানের সাথে দেখা করতেও না দিতে পারেন। অথচ এসব কথাগুলো কেউ বলে না।
এর আগে ২০১৮ সালে অভিনেত্রী বাঁধন স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর তার কন্যার অভিভাবকত্বের আইনি লড়াইয়ে মেয়ের একক অভিভাবকত্ব পেয়েছিলেন।
বিচ্ছেদের পর সন্তানের অভিভাবক কে?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী নুরজাহান মুন্না ইসলাম বলেন, মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে বাবাই হলেন সন্তানের আইনি অভিভাবক। সন্তান সাত বছরের কম হলে মা হবেন কেবল জিম্মাদার বা কাস্টডিয়ান। তবে মা যদি সন্তানের অভিভাবকত্ব চেয়ে আদালতে আবেদন করলে পরিস্থিতি ও সন্তানের ওয়েলফেয়ার বিবেচনায় মা সন্তানের অভিভাবকত্ব পেতে পারেন।